কে হবেন ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি?
নানা নাম নিয়ে জল্পনা-কল্পনা রাজধানীতে যতই ডানা মেলুক না কেন, যতই চলুক না কেন ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ, আসল ইউপিএ প্রার্থী ঠিক কে হবে, সেটি শুধু বিরোধী দল বিজেপি নয়, ইউপিএ-র শরিক নেতাদের কাছেও স্পষ্ট নয়।
গত বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় ঠিক এ রকমই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বহু নাম নিয়ে আলোচনার পর সর্বশেষ বৈঠকে সনিয়া গাঁধী আচমকা মহিলা প্রার্থীর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে প্রতিভা পাটিলের নাম প্রস্তাব করেন। এ বি বর্ধন থেকে অবনী রায় মাথা নেড়ে তা সমর্থন করেন। এ বারও কংগ্রেসের কে প্রার্থী হবেন, সেটা সনিয়া এবং মনমোহন সিংহ ছাড়া আর কেউ এখনও জানেন কি না, তা নিয়ে সন্দিগ্ধ বিজেপি নেতারাও।
কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, রাষ্ট্রপতির পদের প্রার্থী কে হবেন তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, কোন প্রার্থীকে জেতানো সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে কংগ্রেসের মোট ভোট ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৮৫। দ্বিতীয় শক্তিশালী দল বিজেপি-র ভোট ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৮৮৫। এই অবস্থায় সমাজবাদী পার্টির ৬৮,৮১২, তৃণমূলের ৪৮,০৪৯ এবং বহুজন সমাজ পার্টির ৪৩,৩৪৯ ভোট যদি পাওয়া যায়, তা হলে বিজেপি-র সঙ্গে আলোচনার দরকারই থাকে না কংগ্রেসের। আপাতত তাদের প্রথম পরিকল্পনা সেটাই। অর্থাৎ, বিজেপি-র সঙ্গে আলোচনা না করে তিন ‘ম’-এর (মুলায়ম-মমতা-মায়াবতী) সমর্থন নিয়ে ইউপিএ প্রার্থী ঠিক করা। সে জন্য কংগ্রেসের কাউকে প্রার্থী না-করার ব্যাপারেও রাজি হয়ে যেতে পারে তারা।
কিন্তু সেই নামটা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম হলে কংগ্রেসের বিপদ। দিল্লির রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, কালামের নাম প্রস্তাব করতে পারেন মুলায়ম। তাকে সমর্থন করতে পারেন মমতা (এর আগের বার কালামের নাম তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন)। কালামের নিজের রাজ্য তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাও এগিয়ে আসতে পারেন সমর্থনের ঝুলি নিয়ে। কিন্তু কালাম প্রথম বার নির্বাচিত হয়েছিলেন এনডিএ-র প্রার্থী হিসেবে। ফলে এ বার তাঁকে সমর্থন করা কংগ্রেসের পক্ষে কঠিন। তা ছাড়া, একমাত্র রাজেন্দ্র প্রসাদই দু’বার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কংগ্রেস সাধারণ ভাবে দু’বার কাউকে রাষ্ট্রপতি করার পক্ষপাতী নয়।
কংগ্রেসের এই বিপদটাই বাড়িয়ে দিতে চাইছে বিজেপি। তাদের কাছে এটা নিছক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নয়, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের মহড়া নেওয়া একটা সুযোগ। এই ভোটে কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করা গেলে বিজেপি-র রাজনৈতিক লাভ হবে। সেই কারণেই আজ কালাম প্রার্থী হলে সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে তারা। বিজেপি নেতাদের আশা, এর ফলে মুলায়ম-মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের একটা দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব হবে।
শরিকদের সঙ্গে মতৈক্য না-হলে বিজেপি-কে উপরাষ্ট্রপতি পদ দিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করার যে দ্বিতীয় পরিকল্পনা কংগ্রেস করেছে, তাতেও আজ জল ঢেলে দিতে চেয়েছেন নিতিন গডকড়ীরা। তাঁরা স্পষ্টই বলেছেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় বা হামিদ আনসারির মতো কংগ্রেস প্রার্থীকে কোনও অবস্থাতেই সমর্থন করা হবে না। রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেসকে সমর্থন করে উপরাষ্ট্রপতি পদে দলীয় প্রার্থীর জন্য সমর্থন আদায়ের পথে হাঁটবে না বিজেপি।
তবে কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, রাজ্যের জন্য সুদ মকুব বা জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে মমতা কেন্দ্রকে চাপে ফেলতে পারেন, কিন্তু তা-ই বলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিজেপি-র দিকে চলে যাবেন না। মমতার সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। ৩ মে দিল্লিতে সনিয়া-মমতা বৈঠকেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে।
শরিকদের সঙ্গে কথা বলে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে এগোনোর কৌশলই নিচ্ছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। যার অঙ্গ হিসেবে গত কাল করুণানিধির সঙ্গে বৈঠক করেন এ কে অ্যান্টনি। এবং সেই রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবেই আসল নাম নিয়ে এখনই আলোচনা করা হচ্ছে না বলে জানাচ্ছে কংগ্রেস সূত্র। তাদের মতে, সে ক্ষেত্রে নামটি ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তখন বিপদ বাড়বে।
ফলে আপাতত প্রণব মুখোপাধ্যায় বা হামিদ আনসারির নাম নিয়েই আলোচনা চলছে। শরদ পওয়ার বা করুণানিধির সঙ্গে এই দু’টি নাম নিয়েই আলোচনা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তামিলনাড়ু থেকে আসা এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, “ডিএমকে-র কাছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ই প্রথম পছন্দের। তা না হলে কোনও সংখ্যালঘু নেতা। তাই বলে কালামকে কোনও অবস্থাতেই সমর্থন করবে না ডিএমকে।” প্রণববাবুকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক গাল হেসে বলেন, “ওহ্ মাই গুডনেস! কোনও জল্পনাকে প্রশ্রয় দেবেন না।” আর যে অ্যান্টনি গত কাল করুণানিধির কাছে দেখা করতে গিয়েছিলেন, সাংবাদিকরা তাঁকে বলেন, “একমাত্র আপনিই আশার আলো দেখাতে পারেন।” জবাবে কিছুটা রসিকতা করে অ্যান্টনি বলেন, “সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্ত পর্যন্তও কোনও আলো দেখতে পাচ্ছি না।” এরই মধ্যে এনসিপি নেতা পূর্ণ সাংমার মেয়ে আগাথা বলেন, “প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অর্থমন্ত্রীই থাকা উচিত। আজ পর্যন্ত কোনও আদিবাসী বা খ্রিস্টান রাষ্ট্রপতি হননি। ফলে বাবা এ বারে হতে পারেন।”
পাল্টা রণকৌশল স্থির করতে আজ সংসদে লালকৃষ্ণ আডবাণীর কক্ষে বৈঠকে বসেন নিতিন গডকড়ী, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি। পরে সুষমা জানান, এনডিএ-র বাইরে নবীন পট্টনায়ক, জয়ললিতা, চন্দ্রবাবু নায়ডুর পাশাপাশি ইউপিএ-র শরিক দল তৃণমূল, এনসিপি ও মুলায়ম-মায়াবতীর মতো সমর্থকদের সঙ্গেও কথা বলবেন তাঁরা। এই সূত্র ধরে অ-কংগ্রেসি দলগুলি যাতে উপরাষ্ট্রপতি পদে বিজেপি প্রার্থীকে সমর্থন করে, সে চেষ্টাও করা হবে।
আসলে শরিক ও সমর্থনকারী দলগুলির উপরে সনিয়ার নির্ভরতার ফায়দা তুলতে চাইছে বিজেপি। কংগ্রেসের জোট ভাঙার রাজনীতিতেই নেমেছে তারা। লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে অ-কংগ্রেসি জোট বড় করে তার রাশ হাতে রাখতে চাইছে। মমতা-মুলায়মরা শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিলেও যে দলগুলি বিজেপি-র সঙ্গে থাকবে, তাদের একজোট করার চেষ্টা করবেন সুষমারা। |