এল ক্লাসিকোর কোপে মেসির পর রোনাল্ডোরা
রিয়াল মাদ্রিদ-২ (১)
বায়ার্ন মিউনিখ-১ (৩)
মাদ্রিদের ম্যাচে প্রথম দিকটায় ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পা থেকে যখন ক্রমাগত বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে, তখন আর্জেন্তিনায় টুইটারে একটা শব্দ নিয়ে বেশি লেখালেখি চলছিল।
আপ্রেন্দে মেসি।
স্প্যানিশ থেকে বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় ‘শেখো মেসি।”
মেসি কার কাছে শিখবেন? আর্জেন্তিনায় এখনও মেসিবিরোধী লোক প্রচুর। তাঁরা বোঝাতে চাইছিলেন, মেসিকে শিখতে হবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কাছে। পেনাল্টি কিকে গোল করতে। সাত আট জনের রক্ষণ ভেঙে গোল করতে। রিয়াল তখন ২-০ এগিয়ে। দুটো গোলই রোনাল্ডোর। আগের দিন নৌ কাম্পে মেসি যা করতে পারেননি।
টাইব্রেকারে পেনাল্টি নষ্ট করে রোনাল্ডোরা বিদায় নেওয়ায়, আস্তে আস্তে ওই শব্দটা হারিয়ে গিয়েছে টুইটার ট্রেন্ডের তালিকা থেকে। আশা করা যাক, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দিন পর্তুগালে ওই রকম কোনও পর্তুগিজ শব্দ বেরোবে না। আপরেন্দের রোনাল্ডো।
রোনাল্ডো কার কাছে শিখবেন? কেন, রবেনের কাছে! ম্যাচে রবেনেরও পেনাল্টিতে গোল। সারাক্ষণ দৌড়ে গেলেন। তিন-চার জনকে ডজ কিছু ব্যাপারই না। রিয়াল তাঁকে বের করে দিয়েছিল। দু’বছর আগে কাসিয়াস, রামোসদের জন্য বিশ্বকাপ ফাইনালেও তাঁকে কাঁদতে হয়েছিল। মাঠ থেকে বেরিয়ে বলেছেন, “দুটো জ্বালা কাজ করছিল।”
নায়ক থেকে খলনায়ক। ছবি: এএফপি
সেই কবে আমাদের নিজস্ব পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ডাঁটা চচ্চড়ি দিয়ে বিরিয়ানি হয় না।” ঠিক ওই রকমই একটা বিখ্যাত উদ্ধৃতি রয়েছে রিয়াল কোচ মোরিনহোর। ডিম এবং ওমলেট নিয়ে। “ডিম নেই, মানে ওমলেটও নেই। সুপারমার্কেটে গেলে নানা ডিম পাওয়া যায়। এক নম্বর। দুই নম্বর। তিন নম্বর। এক নম্বর ডিম কিনলেই এক নম্বর ওমলেট বানানো যাবে।”
মোরিনহো বোঝাতে চেয়েছিলেন, সেরা টিম করতে গেলে সেরা ফুটবলার কিনতে হবে। মঙ্গলবার টাইব্রেকারে মোরিনহোর সেরা দুই ‘ডিম’ ৬৯০ কোটি টাকার রোনাল্ডো, ৫৫০ কোটি টাকার কাকা শুরুতেই বল জমা দিয়ে দিলেন বায়ার্ন কিপার ন্যুয়েরের হাতে। কাসিয়াস দুটো দুর্দান্ত সেভ করেছিলেন। কিন্তু রামোস একেবারে প্যারাবোলা আঁকার ঢঙে বল উড়িয়ে দেওয়ায় রিয়ালেরও দশা হল বার্সেলোনার মতো। টানা পঁচিশটি পেনাল্টি গোল করেছেন রোনাল্ডো। সব দিন তিনি জেতাবেন, এটা কী করে হয়?
গোল থেকে পেনাল্টি স্পট১২ গজের ওই টাইব্রেকার সরণি বিশ্বের নিষ্ঠুরতম, রহস্যময় রাস্তা। জীবনের মতোই বিচিত্র। এক লহমায় জীবন বদলে দেয়। মেসি, কাকা, রোনাল্ডোও গুলিয়ে ফেলেন পথ। পঞ্চম গোলটা করে পাগলের মতো জামা ওড়াচ্ছিলেন জার্মান তারকা সোয়াইনস্টাইগার। ৮৫ হাজার দর্শক এতটাই চুপ, মনে হচ্ছিল বের্নাবৌতে রবিবারের চার্চে প্রার্থনা শুরু হবে।
২-০ এগিয়েও ঘরের মাঠে স্পেনের দুটো সেরা ক্লাবে বেহালার করুণ সুর কেন? পর পর দু’দিন মেসি-রোনাল্ডোদের দেখে মনে হল, তিন দিন আগের ‘এল ক্লাসিকো’ যেন তাঁদের যাবতীয় উদ্যম, তরতাজা ভাব শুষে নিয়েছে। সব অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ ওই বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ যুদ্ধেই শেষ। আজকের বায়ার্ন কোচ জাপ হেইঙ্কেস ১৯৯৮ সালে ৩২ বছর বাদে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিয়েছিলেন রিয়ালকে। স্রেফ ঘরোয়া লিগে ব্যর্থ হওয়ায় সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। রিয়াল-বার্সেলোনা কি এখনও বুঝল না, এল ক্লাসিকোই সব নয়!
রিয়াল মাদ্রিদকে দেখে আরও মনে হল কথাটা। ফুটবলে জেতার প্রথম শর্ত হল, টেকনিক, ট্যাকটিক্স ও শরীর তিনটি জিনিসকে এক করা। যত সময় এগোল, তিনটি ব্যাপারেই বায়ার্ন টেক্কা দিচ্ছিল রিয়ালকে। ৪-২-৩-১ ছকে মাঝে মাঝেই গতি বাড়িয়ে। লা লিগার সমালোচকরা বলে থাকেন, এখানে ঠিকমতো শক্তি যাচাই হয় না। ইউরোপা লিগে স্পেনের ক্লাবগুলো ভাল খেললেও রিয়াল-বার্সেলোনা ছাড়া বাকি দলগুলো শক্তিহীন। গত ৮ বছরে হয় বার্সা বা রিয়াল, কেউ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। একবার ভিলারিয়াল রানার্স হয়েছিল শুধু। এ বার রিয়াল (৮৮), বার্সেলোনা (৮১)-র অনেক পিছনে তিন নম্বর ভ্যালেন্সিয়া (৫৫)।
চেলসির পরে বায়ার্নও দেখাল, লা লিগায় ঝকমকি পাথর মানেই ইউরোপে আলো জ্বলবে না। ইউরোপ অনেক কঠিন ঠাঁই। বুত্রাগুয়েনো থেকে কাপেলো, সবাই বলছেন, রিয়াল ফুটবলারদের শরীর দেয়নি। মানছেন মোরিনহোও। প্রশ্ন থাকছে, এত বড় দুটো ম্যাচ তিন দিন পরে থাকছে জেনেও লা লিগার কর্তারাই বা কেন ‘এল ক্লাসিকো’ পিছোলেন না? আর্থিক ক্ষতির ভয়ে?
টাইব্রেকার চলার সময় বায়ার্ন সি ই ও কার্ল হাইঞ্জ রুমেনিগের পাশে বসেছিলেন রিয়াল প্রেসিডেন্ট পেরেজ। তখনই নাকি তিনি বলেন, “ম্যানুয়েল ন্যুয়েরই বিশ্বের সেরা গোলকিপার।” পুরো ফুটবল বিশ্বের হদিশ নিলে দেখা যাবে, রিয়ালের পেপে, জাভি আলন্সো, ওজিল, খাদিইরাদের তুলনায় বায়ার্নের নুয়ের, ক্রুস, বোয়াতেং, আলাবা, বাদস্টুবের, গুস্তাফোদের বেশি লোক চেনেই না। অর্থ ও জনপ্রিয়তার জন্য তো জার্মানির সেরা দুই তারকা ওজিল এবং খাদেইরা রিয়ালে চলে এসেছেন। তবু এই ম্যাচটা বোঝাল, জার্মানদের জাত্যাভিমানে মরচে পড়ে না। টাইব্রেকারে সাফল্যের বিচারে জার্মানরা (৮৩ ভাগ) পৃথিবীর এক নম্বর। অন্যরা অনেক পিছনে।
ক’দিন পরের ইউরো কাপে স্পেন আর জার্মানিই ফেভারিট। তার আগে দু’দেশের অন্যতম সেরা ক্লাবের ম্যাচে বল পজেশন (৫৫-৪৫), পাসিং (৬৫১-৪৮৯), গোল শুটিং (১৭-১৩) সবেতেই জার্মানরা এগিয়ে। বায়ার্ন মরসুমের শুরুতে ছিল ইউরোপের ধারাবাহিক দল। মাঝে এলোমেলো হয়ে বুন্দেশলিগাটা হারিয়েছে। কিন্তু ঠিক সময়ে তাদের গ্রাফ উপরের দিকে। পঞ্চপাণ্ডব (রবেন-রিবেরি-সোয়াইনস্টাইগার মারিও গোমেজ-নুয়ের)-এর সৌজন্যে। আগের ম্যাচের নায়ক রিবেরি অত ছন্দে ছিলেন না। তাতেও ক্ষতি হয়নি।
এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন শেষেও বিশ্ব-সেরা দুই ফুটবলারের নাম মেসি-রোনাল্ডোই থাকবে। কিন্তু কাকা? মোরিনহো শেষ দিকে কাকাকে নামিয়েছিলেন। কাকাই বিশ্বের প্রথম ক্রীড়াবিদ, টুইটারে যাঁর অনুগামী ১ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। এ দিন জার্মানদের চক্রবূ্যহে তাঁকে এত শ্লথ দেখাল, রিয়ালে এটাই শেষ মরসুম হলে অবাক হব না। হারের পরে কাসিয়াস তাঁর ফেসবুক ওয়ালে কাকা, রোনাল্ডোদের সাহস জুগিয়েছেন। “তোমরা দারুণ সাহসী।” কাকার ক্ষেত্রে ওটা মানছেন না কর্তা, সমর্থকরা।
মাদ্রিদ, বার্সেলোনার বিশাল স্টেডিয়াম চত্বর এক বছর অন্ধকারে ঢাকা রইল। শুধু ১৯ মে-র লাল বনাম নীলের ফাইনাল দেখতে জেগে থাকছে মিউনিখ। ইতিহাস দেখতেও। ১৯৫৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদ, ১৯৬৫ সালে ইন্টার মিলানের পরে কোনও ক্লাব নিজেদের মাঠে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। মনে হচ্ছে, ইতিহাস হয়ে ওঠার সুযোগ ছাড়বেন না মিউনিখের পঞ্চপাণ্ডব। দ্রোগবা-ল্যাম্পার্ডরা সাবধান।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.