রবিবার তাঁর ষাট বছরের জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পুষ্পস্তবক ও শুভেচ্ছাবার্তা পেলেন নদিয়ার শান্তিপুরের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে। শান্তিপুর থানার এক অফিসার মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো ফুলের তোড়া ও শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে আসেন অজয়বাবুর কাছে। সংক্ষিপ্ত ওই শুভেচ্ছা-বার্তায় লেখা, ‘মঙ্গলময় ঈশ্বরের কাছে আপনার সুখী শান্তিপূর্ণ সুদীর্ঘ জীবন কামনা করছি’। ষাট বছরের জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রীর ‘শুভেচ্ছা’য় স্বভাবতই ‘অভিভূত’ অজয়বাবু ফ্যাক্সবার্তায় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে লিখেছেন, ‘আমার জন্মদিনে আপনার পাঠানো শুভেচ্ছা কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলাম। রাজ্যে সামগ্রিক উন্নয়নে আপনার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস আশার আলো দেখাবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আপনার উন্নয়নের কাজে একজন অংশীদার হওয়ার আগ্রহ রাখি’।
রাজ্য-রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে মমতা-অজয়ের এই ‘শুভেচ্ছা-বিনিময়’কে দুই জোট-শরিকের ‘সৌজন্য-রাজনীতি’ বলেই মনে করছে রাজনীতিক শিবিরের একাংশ। তবে নদিয়ায় জোট-রাজনীতির নিরিখে এই সৌজন্যের ‘সমীকরণ’ অন্যরকম বলেই মনে করছে কংগ্রেসের একাংশ। তাদের মতে, ফুল পাঠানোটা আসলে নদিয়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শঙ্কর সিংহ নামক ‘কাঁটা’ তুলে ফেলার প্রয়াস! |
মাসখানেক পরেই পাঁচটি পুরসভার ভোট। পাঁচটির মধ্যে রয়েছে নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্প। এই কুপার্স ক্যাম্প কার্যত শঙ্করবাবুর ‘দুর্গ’। সেই দুর্গভেদ করে কুপার্স ক্যাম্প জিতে নিতে চান মমতা। কারণ, নদিয়া জেলার রাজনীতিতে শঙ্করবাবুর সঙ্গে মমতার ‘সম্পর্ক’ অজ্ঞাত নয়। অজানা নয় অজয়ের সঙ্গে মমতার ‘সুসম্পর্ক’ও। বিগত লোকসভা ভোটে মমতার প্রচারসভায় হাজির ছিলেন অজয়বাবু। অথচ সেই সভার চৌহদ্দির কোথাও ছিলেন না শঙ্করবাবু। সাম্প্রতিককালে স্বঘোষিত ভাবে শঙ্করবাবু মমতা-বিরোধী শিবিরে। তিনি মমতা-বিরোধী সাংসদ দীপা দাশমুন্সির ঘনিষ্ঠ। কার্যত মমতার কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের এক জন তিনি।
তাই রাজনীতিকদের একাংশের ধারণা, কুপার্স ক্যাম্পের ভোটের আগেই নদিয়ার জেলা কংগ্রেসে বিভাজনের রাজনীতি করে মমতা তাঁর ‘বিরোধী’ শঙ্করকে ধাক্কা দিতে চাইছেন। এবং শঙ্করবাবুও সেটা বিলক্ষণ বোঝেন। তিনি বলেওছেন, “কারও জন্মদিনে ফুল-বেলপাতা পাঠানোর পিছনে রয়েছে কংগ্রেসকে শেষ করার ষড়যন্ত্র। এটা নদিয়ার কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মীরা বোঝেন। এরকম রাজনীতি আগেও হয়েছে। এখনও হচ্ছে। শুধু কুপার্স ক্যাম্পের পুরভোটই নয়। আছে পঞ্চায়েত ভোটও। তৃণমূল নেত্রী জানেন, শঙ্কর সিংহ বাগড়া দিলে নদিয়া জেলাপরিষদ দখল করা যাবে না। তাই কংগ্রেসের বিভাজন ঘটাও। জেলা কংগ্রেস ফুল দেওয়ার ব্যাপারকে কোনও আমল দিচ্ছে না।”
তাঁর নেতৃত্বেই পরপর তিনবার কুপার্স ক্যাম্প পুরসভা দখলে রেখেছে কংগ্রেস। এ বারের ভোট তাই কার্যত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ শঙ্করবাবুর কাছে। ২০০৯ সালের লোকসভা বা গত বছরের বিধানসভা ভেটে জেলায় আসন সংখ্যার নিরিখে কংগ্রেস কার্যত শূন্য হয়ে গিয়েছে। লোকসভায় ওই জেলায় কংগ্রেসকে কোনও আসন ছাড়েননি মমতা। বিধানসভা ভোটেও গরিষ্ঠতা নিয়েই জিতেছে তৃণমূল। এ বার তাই মমতার লক্ষ্য কুপার্স ক্যাম্প পুরসভা এবং তার পরে পঞ্চায়েত দখল করে শঙ্করবাবুর নেতৃত্বাধীন জেলায় কংগ্রেসকে ‘অস্তিত্বহীন’ করে দেওয়া।
এই পুরসভার ১২টি ওয়ার্ডের মধ্যে এখন কংগ্রেসের দখলে আছে ১১টি। একটি সিপিএমের। সেখানে ১২টিতেই জিতে ১২-০ করতে চান মমতা। লক্ষ্যপূরণে ইতিমধ্যেই সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন তিনি। জেলা কংগ্রেসের একাংশের কাছে ‘খবর’ মমতা কুপার্সের ১২টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দিয়েছেন ১২ জন মন্ত্রীকে। আর সার্বিক দায়িত্বে রেলমন্ত্রী তথা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। শুধু নিজের দলের দায়িত্ব স্থির করাই নয়, অজয়বাবুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘বিরোধী’ শিবিরেও ‘ভাঙন’ ধরানোর প্রক্রিয়াটা মমতা শুরু করে দিলেন বলে শাসক দলের একাংশের মত। যার লক্ষ্য একটাই। কুপার্সের ১২-০-তে জয় নিশ্চিত করা। তবে মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রয়াস সত্ত্বেও শঙ্করবাবুর প্রত্যয়, “রানাঘাটের কংগ্রেস শাসিত পুরসভাকে যেমনভাবে ওঁরা (তৃণমূল নেতৃত্ব) দল ভাঙিয়ে নিজেদের দখলে নিয়েছিলেন, কুপার্সকে সেই ভাবেই দখল নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ওঁরা পারছেন না। পারবেনও না।” বরং তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, “ওঁরা নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কুপার্স ক্যাম্পের বাসিন্দাদের। যেমন মুকুল বলেছেন, রেলের ফাঁকা জমিতে পাট্টা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। কেউ বা স্কুল করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু কুপার্স ক্যাম্পের মানুষ যে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেসকে পরপর তিনবার পুরবোর্ডে ক্ষমতায় রেখেছেন, তাঁরা এবারও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
প্রসঙ্গত, শঙ্করবাবুর প্রাক্তন অনুগামী পার্থসারথি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একদা কংগ্রেসের দখলে থাকা রানাঘাট পুরসভা এখন তৃণমূলের হাতে। ১৯ ওয়ার্ডের রানাঘাট পুরসভায় ২০০৯ সালে পার্থবাবু-সহ ১৬জন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। পরের বছর পুরভোটে পার্থবাবুরা ১৬টি আসনে জিতে রানাঘাটের ক্ষমতা পান। কংগ্রেসের তিন জয়ী কাউন্সিলারের মধ্যে একজন এখন তৃণমূলে। সেই পার্থবাবুর সঙ্গে অজয়বাবু ‘হাত মিলিয়ে’ নদিয়ায় কংগ্রেসকে তৃণমূলের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন শঙ্করবাবু। কিন্তু অভিযোগটি ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়ে পার্থবাবু বলেন, “অজয়দার সঙ্গে সম্প্রতি আমার দেখা বা কথা হয়নি। তবে কুপার্সের অনেকেই আমাদের মতো কংগ্রেস ছাড়তে চান। কিন্তু আমরা সাহস করে যা করতে পেরেছি, ওঁরা যে কোনও কারণেই হোক, তা পারছেন না।”
এই পরিস্থিতিতে দেখার, অজয়বাবুকে ফুল পাঠানোর ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোম্যাসি’তে মুখ্যমন্ত্রী কুপার্সে শঙ্কর-কাঁটা তুলতে পারেন কি না! |