|
|
|
|
রাতেই সম্পন্ন শেষকৃত্য |
শোকের ছায়া চকদ্বীপায় |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
থমথমে ভাবটা টের পাওয়া যাচ্ছিল ব্রজলালচক থেকে চকদ্বীপা যাওয়ার পথেই। তারাপীঠে পুজো দিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত ৬ জনের বাড়িটা চেনা গেল কান্নার রোল শুনে।
হলদিয়ার চকদ্বীপা গ্রামের বাসিন্দা পেশায় সমবায় সমিতির ম্যানেজার শৈলেন বিষয়ী বড় মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনীর সঙ্গে স্ত্রী, ছোট মেয়েকে নিয়ে তারাপীঠে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। পেশায় পরিবহণ ব্যবসায়ী জামাইয়ের গাড়িতে চেপে শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ হলদিয়া থেকে রওনা দেন তাঁরা। শনিবার পুজো দিয়ে ফিরছিলেন। দুপুরবেলা হুগলির হরিপালের কাছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের কানগোইতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পিছনে ধাক্কা মারে দ্রুতগতির গাড়িটি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় শৈলেনবাবু (৫৫), তাঁর স্ত্রী ঝর্ণাদেবী (৪৪), ছোট মেয়ে অপর্ণা (২২), জামাই অহীন্দ্র মাইতি (৩৬) ও অহীন্দ্রবাবুর ছেলে সৌম্যদীপের (৮)। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান অহীন্দ্রবাবুর স্ত্রী অপর্ণাদেবী (২৮)। শুধু প্রাণে বেঁচে ফিরেছে তাঁদের বছর দেড়েকের মেয়ে শ্রেয়সী। |
|
শোকার্ত সূর্যমণিদেবী। নিজস্ব চিত্র। |
দুর্ঘটনার খবরটা বাড়িতে পৌঁছেছিল শনিবার বিকেলেই। রবিবার বেলা ১২টায় ময়না-তদন্তের পর মৃতদেহগুলি পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শেষ দেখার জন্য দুপুর থেকেই চকদ্বীপা গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়। বাড়ির উঠোনে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন শৈলেনবাবুর মেজ মেয়ে ঋতুপর্ণা দোলই। তিনি বলেন, “আমার চার বছরের মেয়ে প্রমিতাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বাবা। আমি বাধা দেওয়ায় মেয়ে কান্নাকাটি করছিল। বাবা বলেছিলেন ফিরে এসে অন্য জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবেন। বাবা ফিরবেন না। মা-বোনরাও নেই। আমি একা হয়ে গেলাম।” শৈলেনবাবুর মা, নব্বই বছরের সূর্যমণিদেবীকে প্রথমটায় দুঃসংবাদ দেওয়া হয়নি। এ দিন সকালে ছোলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন তিনি। শৈলেনবাবুর সহকর্মী তথা প্রতিবেশী পূর্ণেন্দু পাঞ্জার কথায়, “এত ভাল মানুষ খুব কম হয়। গ্রামের সকলের যতটা সম্ভব উপকারের চেষ্টা করতেন। আমরা মর্মাহত।” শৈলেনবাবুর মেজ ভাই স্বামী বিশেষানন্দ রামপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ। দিনভর গীতাপাঠের আয়োজন করেছেন তিনি।
মাইতি পরিবারের ছোট ছেলে অহীন্দ্রবাবুর মৃত্যুসংবাদে শোকের ছায়া দেভোগ গ্রামেও। বাবা নিশিকান্ত মাইতির পরিবহণ ব্যবসার হাল ধরেছিলেন অহীন্দ্রবাবু। এর আগে নিজের গাড়িতে অনেক জায়গায় বেড়িয়েছেন। নিজেও গাড়ি ভালই চালাতেন। নিশিকান্তবাবু বলেন, “শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে তারাপীঠে পুজো দিতে গিয়েছিল। আগেও এরকম অনেক গিয়েছে। কিন্তু এ বার আর ফিরে আসবে না ও। দুঃস্বপ্ন দেখছি মনে হচ্ছে।’’ দুর্ঘটনার দিন শেষ বারের মতো ফোনে ভাগ্নে সোমনাথ জানার সঙ্গে কথা হয়েছিল অহীন্দ্রবাবুর। সোমনাথ বলেন, “বলেছিল তারাপীঠ থেকে রওনা দিয়েছে। ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তাই হচ্ছিল। দুঃসংবাদটা পরে শুনে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।”
রবিবার ভোরেই কলকাতার হাসপাতাল থেকে মস্তিস্কের স্ক্যান করিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে অহীন্দ্র-শ্রীপর্ণার মেয়ে শ্রেয়সীকে। আপাতত ঠাকুমা বাসন্তীদেবীর কাছেই রয়েছে সে। পরিবারের সদস্যরা জানালেন, গাড়ির সিটের নীচে জ্ঞানহারা অবস্থায় পড়েছিল শ্রেয়সী। জ্ঞান ফিরতেই কেঁদে উঠলে পুলিশের নজরে আসে। এখন ভালই আছে সে। তবে মাঝে মধ্যেই কেঁদে উঠছে। দাদু নিশিকান্তবাবুর কথায়, “মা-বাবাকে খুঁজছে। কী ভাবে ভোলাব, কী জবাব দেববুঝতে পারছি না।” এ দিন সন্ধ্যায় মৃতদেহগুলি এসে পৌঁছয় চকদ্বীপায়। রাতেই চকদ্বীপার কাছে শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। |
|
|
|
|
|