|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
অতি-প্রতিক্রিয়া |
কালীঘাট মন্দিরের পরিবেশ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে হস্তক্ষেপ করিতে হইল। এক রায়ে তিনি মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা-সহ ব্যাপক পুলিশি ও নিরাপত্তা বন্দোবস্ত প্রবর্তনের নির্দেশ দিলেন। দেশের আর সব তীর্থস্থানের মতো কালীঘাটের এই মন্দিরেও পাণ্ডা-সেবায়েতদের শোষণ ও অত্যাচারের অভিযোগ, পুণ্যার্থীদের হেনস্থা ও নিগ্রহের অভিযোগ, ভিআইপি দর্শনার্থীদের নিয়ম-বহির্ভূত সুবিধাভোগের অভিযোগ। পুণ্যার্থীরাই অভিযোগ লইয়া আদালতের দ্বারস্থ হইয়াছিলেন। সেই জনস্বার্থ মামলার সূত্রেই আদালতের রায়। সাধারণ পুণ্যার্থীরা রায় শুনিয়া যেমন মহাখুশি, পাণ্ডা-পুরোহিত ও ভিআইপি দর্শনার্থীরা তেমনই অসন্তুষ্ট।
এই সকল দেবালয় ও তাহার সঞ্চালন সচরাচর বিভিন্ন অছি পর্ষৎ-এর উপরেই ন্যস্ত থাকে। পুণ্যার্থীদের জন্য রকমারি বন্দোবস্ত, মন্দির চত্বর পরিচ্ছন্ন রাখা, সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সর্বোপরি অনুকূল আধ্যাত্মিক পরিবেশ রচনা করার যাবতীয় দায় ওই সব সংগঠন বা কমিটির কৃত্যের মধ্যেই পড়ে। ইহার মধ্যে সরকার কিংবা আদালত, অর্থাৎ প্রশাসন কিংবা বিচারবিভাগ কেন নাক গলাইবে, তাহা বোঝা দুষ্কর। আদালতে যে-কেহই যে-কোনও অভিযোগ লইয়া প্রতিকারের আশায় হাজির হইতে পারে। কিন্তু আদালত কোন অভিযোগ বিচারের জন্য গ্রহণ করিবে, সেটা মহামান্য বিচারকদেরই বিবেচ্য। বিশেষত যখন অগণিত জরুরি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা স্রেফ বিচারকের অভাবে বছরের পর বছর আমীমাংসিত পড়িয়া আছে? মন্দির-অঙ্গনে যদি বড় কোনও সমস্যার উদ্ভব হয়, যাহা মন্দির কর্তৃপক্ষ সামলাইতে অপারগ, সে ক্ষেত্রে প্রশাসন হয়তো হস্তক্ষেপ করিতে পারে, কিন্তু আদালত কেন?
সঙ্গে সঙ্গেই বলা দরকার, প্রয়োজনে যেমন প্রশাসনের দ্বারস্থ হওয়া চলিতে পারে, তেমনই অত্যধিক প্রশাসনমুখিতারও কোনও দরকার নাই। সরকার কেন-ই বা এই সব প্রশ্নে আগ বাড়াইয়া মাথা ঘামাইবে, যদি না পাণ্ডা বনাম ভক্তদের বিরোধ কোনও আইনশৃঙ্খলার সমস্যা তৈয়ার করে? যদি না অন্য ধরনের কোনও গুরুতর নিরাপত্তা-জনিত প্রশ্ন উপস্থিত হয়? সাধারণ গণস্থান বা ‘পাবলিক স্পেস’-এ নিরাপত্তার জন্য যতটুকু দরকার, মন্দিরের ক্ষেত্রেও প্রশাসনব্যবস্থার সেটুকুই কর্তব্য। তাহার অতিরিক্ত মাথা ঘামানো সরকারের পক্ষে অকর্তব্য। অন্যান্য গণস্থানের মতোই কালীঘাটের মন্দিরও একটি জনসাধারণের গম্য স্থান। সেখানে মঙ্গল ও শনিবার যদি বাড়তি পুণ্যার্থীরা সেখানে ভিড় করেন, তবে প্রশাসন বা আদালত তাহাতে হস্তক্ষেপ করিবে কোন অধিকারে? ভক্ত দেবস্থানে গিয়া কখন তাঁহার ভক্তি প্রকাশ করিবেন, তাহা নিশ্চয়ই সরকার বা আদালত ঠিক করিয়া দেবেন না। অবশ্য যদি ইহার কারণে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে অন্য কথা। সে ক্ষেত্রে আইনরক্ষকরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা লইতেই পারেন, লওয়াই বাঞ্ছনীয়। পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, মন্দিরগামী পথঘাট মসৃণ ও পরিচ্ছন্ন রাখা, বিদ্যুৎ-সংযোগ অবিচ্ছিন্ন রাখা, ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ের বাহিরে প্রশাসন বা আদালত মন্দিরের অন্যান্য কার্যকলাপে কেনই বা হস্তক্ষেপ করিবে। বিশেষত উভয়েরই যখন অন্য অনেক কাজ দীর্ঘ কাল যাবৎ বকেয়া, অসমাপ্ত, এমনকী অনারব্ধ পড়িয়া আছে। সাধারণ নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটির একটি অংশ হিসাবে মন্দিরপ্রবেশের বিষয়টি দেখিলে, এবং তাহার বাহিরে ভক্ত ও ভক্তির পদ্ধতি-প্রকরণ লইয়া মাথা না ঘামাইলেই সমাজের অধিকতর মঙ্গল। |
|
|
|
|
|