|
|
|
|
বৈশাখী বর্ষবরণের ছন্দে জঙ্গলমহল |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
গত তিন বছরে অশান্তির জেরে বৈশাখী-বর্ষবরণ কার্যত ভুলে গিয়েছিল জঙ্গলমহল। সন্ত্রাস ও বন্ধ-অবরোধের রোজনামচায় নিয়ম রক্ষার ম্লান-ছবিতে পর্যবশিত হয়েছিল পয়লা বৈশাখ। রাজ্যের মসনদে পালাবদলের পর এ বার চৈত্র-অবসানে জঙ্গলমহলেও পরিবর্তনের হাওয়া। জমে উঠেছে চৈত্র সেলের বাজার। বিভিন্ন এলাকায় বসেছে চড়ক ও গাজনের মেলা। জোরকদমে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতিও। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে লালগড়ে সাহিত্য বাসরের আয়োজন করেছে স্থানীয় ‘সুস্বন’ সাহিত্য পত্রিকা গোষ্ঠী। ২০০১ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সাহিত্য বাসর গত তিন বছর বন্ধ ছিল। |
|
ঝাড়গ্রামে চৈত্র সেলের কেনাকাটা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, লালগড় ছন্দে ফেরার ছবি জঙ্গলমহলের সর্বত্রই। চৈত্রসেলের বাজারে ভিড়। গাঁ-গঞ্জের লোকজন মফঃস্বল বা শহরে বাজার করতে আসছেন। ছোট দোকানি থেকে বড় ব্যবসায়ী সকলের মুখেই হাসি। ঝাড়গ্রাম শহরের জুবিলি মার্কেট মেন রোড ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সন্তোষ সোমানি বলেন, “পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হওয়ায় ব্যবসায়ীদের দুঃখ ঘুচেছে। মফঃস্বল ও গ্রামগঞ্জের লোকেরা শহরে কেনাকাটা করতে আসছেন। ফলে এ বার পয়লা বৈশাখ ও অক্ষয় তৃতীয়ায় দিনে হালখাতায় সাধ্যমতো আয়োজন হবে। বিগত দিনের দুঃস্বপ্ন সকলেই ভুলতে চান।” জুবিলি বাজারের ছোট কাপড় ব্যবসায়ী সুবীর কুণ্ডুর অবশ্য বক্তব্য, “গ্রামগঞ্জের লোকজনের ভিড় বেড়েছে, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কিছুটা কমে গিয়েছে। শান্তি ফিরেছে। এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।” বেলপাহাড়ির একটি জুতোর দোকানের মালিক মণীন্দ্র মাসান্তের কথায়, “আগে দূরের খদ্দেররা আসতেনই না। সন্ধের পর দোকান খোলা রাখার ঝুঁকিও নিতাম না। এখন রাত পর্যন্ত ভাল বিক্রিবাটা হচ্ছে।” একই বক্তব্য লালগড়ের বস্ত্রব্যবসায়ী জিতেন মাহাতোরও।
জঙ্গলমহলের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, বিগত বছরগুলিতে চৈত্র-সেলের সময় টানা বন্ধ-অবরোধের জন্য বেশির ভাগ দোকানেই পুরনো ‘স্টক’ ফাঁকা হত না। এ বার সেটা হচ্ছে। গত কয়েকটি বছর নববর্ষে ক্রেতাদের ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট দেওয়ার ব্যাপারেও রাশ টানতে হয়েছিল ব্যবসায়ীদের। এ বার? লালগড়ের এসআই চকের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী দীনেশ দাস বলেন, “এ বার পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে গিয়েছে। পয়লা বৈশাখে মালাই-চমচম, চিত্রকূট, ছানার পায়েস, মায়াভোগ, ক্ষীরকদম্বের মতো রকমারি মিষ্টি বানানোর জন্য অর্ডার পেয়েছি। গত তিন বছর নববর্ষে এ সব মিষ্টি বানানো হয়নি।” ঝাড়গ্রাম শহরের ফুল বিক্রেতা গোবিন্দ সামন্ত জানালেন, অশান্তি চলাকালীন আগের বছরগুলিতে হালখাতার জন্য ফুলের তেমন চাহিদা ছিল না। এ বার চাহিদা বেড়েছে।
লালগড়ের ‘সুস্বন’ ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকার উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সাহিত্য-বাসর হয়ে থাকে। কিন্তু অশান্ত পরিবেশে গত তিন বছর তা করা যায়নি। পত্রিকার সম্পাদক পঙ্কজকুমার মণ্ডল বলেন, “এ বার নববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে শনিবার স্থানীয় স্কুলের অডিটোরিয়ামে সাহিত্য-বাসরের আয়োজন করা হয়েছে। কলকাতা ও জেলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে।” বেলপাহাড়ির রুপাই, ঝাড়গ্রামের চন্দ্রি, নয়াগ্রামের রামেশ্বর, বেলিয়াবেড়ার চোরচিতা, লালগড়ের গোহমি ও নেতাইয়ের মতো বিভিন্ন গাঁ-গঞ্জে চড়ক-গাজনের মেলাও চলছে জোরকদমে। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বিগত বছরগুলিতে অশান্তির কারণে কোনওমতে নিয়মরক্ষার অনুষ্ঠান হলেও অনেক জায়গাতেই সে ভাবে মেলার আয়োজন করা হয়ে ওঠেনি। এ বার সব জায়গাতেই শিবের গাজনের জাঁক বেড়েছে। মনোবিদ দীপঙ্কর পালের মতে, “বিগত কয়েক মাস ধরেই ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার এই পরিবর্তনটা টের পাওয়া যাচ্ছে। অবরুদ্ধ ও অবদমিত আবেগকে সুদেআসলে পুষিয়ে নেওয়ার এই প্রবৃত্তি সহজাত।”
|
|
|
|
|
|