|
|
|
|
সুবর্ণরেখার চরে চৈত্রসংক্রান্তি মেলায় আজও অম্লান ঐতিহ্য |
অমিত কর মহাপাত্র • দাঁতন |
‘বালির উপরে মেলা মাত্র একদিন
বালিযাত্রা নাম হয় অনেক প্রাচীন
আজি হতে পাঁচ হাজার আশি সংবৎসর
বর্তমান গত ইহা কলির বৎসর’
লোককবি সুরেশচন্দ্রের পদে এই উল্লেখ দাঁতনে সুবর্ণরেখার চরে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা প্রসঙ্গে।
গোপীবল্লভপুরের করবনিয়া গ্রামে নদী উত্তরবাহিনী বলে সেখানে স্নান ‘পুণ্যস্নান’ বলে বিবেচিত হয়। হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন। লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, দাঁতনে ওই নদী দক্ষিণ বা পূর্ববাহিনী হলেও করবনিয়ার দেখাদেখি কিছুকাল পরে দাঁতনের বেলমূলা ঘাট, বারাসতী ঘাট ও সোনাকালিয়া ঘাটেও কয়েকশো বছর ধরে এই মেলা হয়ে আসছে। মেলার নাম কোথাও বালিযাত্রা, বালিযাত, নদীযাত্রা বা বালিমেলা।
অশোক মিত্র সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বালিযাত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব উপলক্ষে সুবর্ণরেখা নদীতে পুণ্যস্নান ও পরলোকগত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণাদির জন্য মেদিনীপুর জেলার বিভিন্ন স্থান হইতে বহু নরনারী আসিয়া থাকেন। কিংবদন্তী আছে, পাণ্ডবগণ অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন ওই স্থানে চৈত্র সংক্রান্তি তিথিতে উত্তরবাহিনী সুবর্ণরেখা নদীতে স্নান ও পিতৃতর্পণাদি করিয়াছিলেন।” পাণ্ডবদের কাহিনীর পাশাপাশি জনশ্রুতি রয়েছে বারাসতী ঘাটের বিষয়েও। কথিত আছে বারো সতী বা বারো স্রোত থেকেই এই নামকরণ হয়েছে। কোনও সময় হয়তো বারোজন সতীকে দাহ করা হয়েছিল বা এই অংশে চৈত্র মাসের সময়ে নদীতে বারোটি পৃথক স্রোত ছিল। আবার কবি দীনকৃষ্ণের ‘রসকল্লোল’ কাব্যে জানা যায়, ১৫১০ সালের চৈত্র সংক্রান্তির দিন বারাসতী ঘাট থেকে নদী পেরিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। আবার ওই ঘাটেই চৈতন্যদেবের পুণ্যস্নানের কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে।
দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের মতো লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যও চোখে পড়ে এই মেলায়। মেলাগুলিও গড়ে উঠেছে আপন বৈশিষ্ট্যে লোককথা-কাহিনী, ছড়া, গান ও বিশ্বাসে ভিত্তি করে। সুবর্ণরেখা নদীকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে এক পৃথক সংস্কৃতির ধারা বহমান, যা দাঁতনের এই তিনটি মেলার বৈশিষ্ট্য। গত প্রায় দু’দশক ধরে মেলাগুলিতে ঝাড়খণ্ডের মানুষের আসা কমে গেলেও উৎসাহ বেড়েছে নদীর দু’তীরের বাংলা ও ওড়িশার মানুষের। ফলে ইদানীং গড়ে উঠেছে একটি পৃথক মিশ্র সংস্কৃতি। মেলাগুলিতে মুছে গিয়েছে ধর্মীয় বৈষম্য। দাঁতনের দুই বাসিন্দা অতনুনন্দন মাইতি ও মন্মথনাথ গোরায় গত কয়েক দশক ধরে লোকসংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত জেলাগুলিতে যোগ দেন ধর্মীয় আচারের জন্য। তাঁদের মতে, এই মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল যে এই মেলার কোনও সংগঠন নেই। চিরাচরিতভাবে মানুষ নিজের মতো আসেন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। আবার সূর্যাস্তের সঙ্গেই তাঁরা চলে যান।
নদীর পূর্ব পাড়ে প্রশস্ত বালিভূমিতেই মেলা বসে। শুধু পুণ্য অর্জনই লক্ষ্য নয়, চৈত্র শেষের মনোরম সকালে সুবর্ণরেখার জলে ঝাঁপ দেয় শিশু-কিশোরও। এই মেলায় পৃথকভাবে বিনোদনের কোনও উপকরণ থাকে না। নদীর দুই তীরের পসারিরা তালপাতা, বাঁশের পাখা, মাটির পাত্র, গ্রামীণ কুটির শিল্পজাত খেলনা, নদীর দুই তারের উর্বর জমিতে উৎপাদিত শস্য, সবজি ও ফল নিয়ে হাজির হন। মেলা থেকে সবাই পরম্পরাগতভাবে কিনে নিয়ে যান নতুন বছরে ব্যবহারের জন্য ‘বসুন্ধরা হাঁড়ি’ ও ‘চনা’ নামের একপ্রকার ডালশস্য ভাজা।
এ ভাবেই নদীর দুই তীরের সখ্য হয়। নদীর গরম বালির উপর দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে যান সকলে। চৈত্র সংক্রান্তির বিকেলে প্রাচীন ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্যকে বালিভূমিতে রেখেই তার স্মৃতি নিয়ে একা বয়ে যায় সুবর্ণরেখা।
|
|
|
|
|
|