বুধবার ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের কাছে সংঘটিত ভূমিকম্পের প্রভাবে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তাহা অভূতপূর্ব। ইহার কারণ নিশ্চয় ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ঘটিয়া যাওয়া ধ্বংসাত্মক সুনামি, যাহা কেবল সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই নয়, ভারতীয় উপকূলেও ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। সেই হইতে সমুদ্রের গভীরে ভূকম্প ঘটিলেই আশেপাশে সুনামির সতর্কবার্তা জারি করা হয়, যেমন এ বারেও করা হইয়াছিল। গত বছর জাপানে ভয়ঙ্কর সুনামির জেরে পরমাণু কেন্দ্রে বিপর্যয়ের স্মৃতিও জনসাধারণের মনে টাটকা। ফলে এ বার সুমাত্রার ভূকম্পের সংবাদ পাওয়ামাত্র কলিকাতার মতো শহরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনসাধারণ সতর্ক হইয়া ওঠেন। অস্বাভাবিক নয়।
পাতাল রেল ভূমিকম্পের মতো দুর্বিপাকের ক্ষেত্রে গণমৃত্যুর ফাঁদ হইয়া উঠিতে পারে। কম্পনের প্রভাবে ভূগর্ভস্থ এই সুড়ঙ্গপথ যদি ধসিয়া পড়ে, তবে তাহাতে অগণিত মানুষের জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার আশঙ্কা। কর্তৃপক্ষ তাই কোনও ঝুঁকি না লইয়া অচিরে সব চলন্ত ট্রেন নিকটবর্তী প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করাইয়া যাত্রীদের দ্রুত পাতালপথ হইতে বাহির করিয়া দেন এবং অন্তত এক ঘণ্টার জন্য রেল-চলাচল বন্ধ রাখেন। কম্পন অনুভূত হওয়া মাত্র কিংবা মোবাইল ফোনে তাহার সংবাদ পাওয়া মাত্র বিভিন্ন বহুতল হইতে যে দ্রুত অফিস-কর্মীরা বাহিরে রাস্তায় নামিয়া আসিয়াছেন, সেটাও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয়। কেননা কলিকাতার বহুতলগুলি জাপানের মতো ভূকম্পপ্রতিরোধী ভিতের উপর নির্মিত নয়। কোনও কম্পন ছাড়াই পৃথিবীর স্বাভাবিক আহ্নিক ও বার্ষিক গতির মধ্যেই সামান্য বৃষ্টিতে তাহাদের ধসিয়া পড়ার নজির আছে। কখনও-সখনও এমনকী বৈশাখী ঝড়েও শহরের নূতন-পুরাতন অট্টালিকার দেওয়াল ভাঙিয়া পড়ে। তাই ভূমিকম্পের খবর পাইলে ওই সব ভঙ্গুর বহুতলের আশ্রয়কে নিরাপদ গণ্য না-করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই পর্বেই অবশ্য আতঙ্ক এবং গুজবও ছড়াইতে দেখা গিয়াছে। রাস্তায় জড়ো হইয়া উঁচু বাড়িগুলির মাথা-বরাবর আপাদমস্তক ফাটলের চিহ্ন নিরীক্ষণের আগ্রহও লক্ষ করা গিয়াছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মোবাইল ফোনের জীবন্ত ধারাবিবরণীতে শহর, রাজ্য, এমনকী দেশময় সেই সব সমাচার কিংবা অমুক বাড়িটিতে ভাঙনের চিহ্ন আবিষ্কারের গুজব ছড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। আশপাশের লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বিপর্যয় দেখিতে পিলপিল করিয়া সমবেত হইয়া অবশেষে হতাশ হইয়া ফিরিয়াও গিয়াছে। এ সবই বাঙালির স্বভাব ও মানসিকতার সহিত অতীব সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এ ধরনের হল্লাপ্রিয়তা ও গুজবকাতরতার ছিদ্রপথেই প্রবেশ করে অসতর্কতার বিপন্নতা। একে তো কলিকাতার অধিকাংশ ঘরবাড়ি স্থাপত্যের ন্যূনতম নিয়ম না মানিয়া নির্মিত। উপরন্তু ভারত ও তাহার পূর্বাঞ্চলের ভূ-স্তরের প্রেক্ষাপট ও অবস্থান উত্তরোত্তর এই অঞ্চলকে ভূকম্পপ্রবণ করিয়া তুলিতেছে। ভূতাত্ত্বিকরা আশঙ্কা করিতেছেন, একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়তো এই ভূ-স্তরের নীচে জায়মান এবং হিমালয়সংলগ্ন এলাকায় তাহা বিস্ফোরিত হইতে পারে। সুমাত্রার কাঁপন হয়তো একটা হুঁশিয়ারি দিয়া গেল। অপ্রস্তুত দশা হইতে নির্গত হওয়ার হুঁশিয়ারি। |