|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
হাওয়ার উপর ঘর, হাওয়া ঘুরলে তো ভাঙবেই |
তবে কেন বলা হয়েছিল, পুনর্বাসন না দিয়ে উচ্ছেদ হবে না কোথাও?
কেন তবে ওরা সবাই মিছিলে হাঁটল, ভোট দিয়ে এল পরিবর্তনকে? লিখছেন
স্বাতী ভট্টাচার্য |
আমরা কোথায় যাব, তোমরা বলে দাও। চোয়াল রাগে শক্ত, চাহনি যেন চড়া রোদ। মেয়েদের মাথায় ছাপা শাড়ির আধ-ঘোমটা, ছেলেদের টি-শার্টের নীচে লুঙ্গি, হাতে ঢলঢলে স্টিলের ঘড়ি। ওদের প্লাস্টিকের চটির নীচে বাঁশের টুকরো, দরমার চাটাই, ভাঙা টালি, নীল পলিথিন চাদর, খোঁদল-হওয়া মাটিতে ঘোলা জল। ক’হাত দূরে ইতস্তত পুড়ে-যাওয়া ঘরের কালো ছাই, সাদা পাঁশ। পিছনে বিশাল সবুজ মাঠ। নতুন ঘাসে, বর্ষার জলে, কালো মেঘের ফাঁকে ছিটকে-আসা রোদে এলাহি জমিখানা ঝলমল করছে। সেখানে হইহই খেলছে রঙিন পোশাক-পরা শিশুরা। ছাদ নেই, দেওয়াল নেই, ওদের ভারী বয়েই গেল। জোর বৃষ্টি এলে মায়েরা বুকে তুলে ছুটে গিয়ে সেঁধোবে মাঠের পিছন দিকে ফেলে-রাখা জল যাওয়ার বড় বড় পাইপগুলোর ভিতর। তখনও ওই খুদেরা ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করবে, খেলা বাদ পড়ে যায় যে!
এক দিন ওরা বুঝবে, ১৪১৮ সালের শেষ চৈত্রের একটা দিনে, যে দিন ওদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ, সে দিন ওরা বাদ পড়ে গিয়েছিল কোন খেলা থেকে। বাবা-মায়েরা কিন্তু টের পেয়েছিল, খেলা কোন দিকে ঘুরতে যাচ্ছে। ‘আয়ার কাজ করতাম, নমিতা সেন্টার,’ বলছিল ময়না হালদার। ‘তিন মাসে মাত্র ছ’দিন কাজ করেছি, কেবল শুনছি আজ ভাঙে, কাল ভাঙে।’ ওরা ঘর আগলে বসেছিল, রাজমিস্ত্রিকে জোগাড়-দেওয়ার ইট না ছুঁয়ে, বাবুর বাড়ি বাসনের ডাঁই ফেলে রেখে। সেই সব ঘরের যে অবশিষ্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, তাতে বিশ্বাস হতে চায় না যে, ১৩৬টা পরিবার বাস করত এখানে। বলতেই হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই, ‘এক এক ঘরে কত জন থাকতাম, তা জানেন?’ সেই থাকাও তেমনি-- বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, বাথরুম বলতে মাঠ, সন্ধে হলে ৪০ টাকা-লিটার কেরোসিন, রান্না করা পাঁচ টাকা-বাণ্ডিল কাঠে। না-চাইতে পাওয়া কেবল মশা। ‘গরু-ছাগলও বাস করতে পারে না এমন মশা, থাকুন না সন্ধের পর, দেখবেন,’ খরখর করে উঠল মেয়েরা। |
|
অতীত? নোনাডাঙা, ২০০৭। |
তবে থাকা কেন? অমনি মুখগুলো ভেঙেচুরে গেল। ‘বাড়ি ভাড়া দিতে পারছিলাম না যে। এইটুকু একটা ঘরের জন্য কেউ হাজার টাকা চায়, কেউ সাতশো টাকা। তা-ও ১১ মাস হল তো তল্পি গোটাও।’ কেউ এসেছে উত্তর ২৪ পরগনার তালদি থেকে, কেউ জয়নগর, লক্ষ্মীকান্তপুর, ক্যানিং থেকে। বেশির ভাগ আশেপাশের যমুনানগর, অহল্যানগর, আদর্শনগর, গরফা, রাজডাঙা থেকে। বাইশ বছর কলকাতার নানা বস্তিতে ভাড়া থেকে শেষে নোনাডাঙায় নিজের ঘর বেঁধেছিলেন খোকন নাইয়া। আড়াই হাজারি-চার হাজারি পরিবারে হাজার টাকার সাশ্রয় অনেকখানি। ‘এখানে এসে একটু ইনকাম হচ্ছিল।’ সেই সঙ্গে এক চিলতে আশা, কয়েক বছর কষ্ট করলে একটা ১৬ বাই ১০ ফ্ল্যাট কি জুটবে না? যেমন জুটেছে বেলেঘাটা গোবিন্দপুর-রাজডাঙার লোকেদের?
কত দিন বস্তিবাস করলে উচ্ছেদ ‘বৈধ’ হয়, ওরা জানে না। এখন শুনছে, নোনাডাঙায় যারা তিন বছর বাস করছে, তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হতে পারে। তা হলে সবিতা দাসের কী হবে? সে তো ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ঘর তুলেছিল দু’বছর আগে। এখনও দেড় হাজার টাকা শোধ দেওয়া বাকি, এ দিকে ঘর পুড়ে শেষ। কে যে ঠিক করে খেলার নিয়ম, কে যে নিয়ম বদলে দেয়। তবে কেন বলা হয়েছিল, পুনর্বাসন না দিয়ে উচ্ছেদ হবে না কোথাও? কেন সেই দাদা, যে এখন মন্ত্রী, নোনাডাঙা এসে বলে গিয়েছিল, এখান থেকে একটা ঘরও সরবে না? কেন তবে ওরা সবাই মিছিলে হাঁটল কেউ বাপের বাড়ির পাড়া, কেউ গ্রামের ভিটেতে গিয়ে ভোট দিয়ে এল পরিবর্তনকে? কেন মাঠের চার দিকে আগেই কাঁটাতার ঘিরে দেয়নি কেউ, পাঁচিল দেয়নি, বোর্ড লাগায়নি, ঘোষণা করেনি এই মাঠটা অমুকের, এখানে তমুক তৈরি হবে? কেন, কেন, কেন ...?
বাঁশের চোঁচ-এর মতো সব প্রশ্নের পিছনে থেকে যায় না-বলা কথাটা নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের পর কী করে হয় নোনাডাঙা? ম্যাটাডোর-ভর্তি মেয়েরা তিন দিন কালীঘাট গিয়েছে, কমিটির লোকেরা ‘মাননীয় উন্নয়ন মন্ত্রী’কে বাংলা টাইপে চিঠি দিয়ে ১৩ মার্চ ‘রিসিভড’ ছাপ মেরে নিয়ে এসেছে। তার শেষ প্যারাগ্রাফ, ‘সহায় সম্বলহীন গরিব শেষ প্রাণে এসে পৌঁছেছি। তাই সাত-আট শত গরিবের শেষ আবেদন, একটি বার যদি এসে নিজে চোখে দেখেন, যদি মনে করেন আমরা উচ্ছেদ হয়ে দুঃখ পাব না, শুধু একটি বার এসে দেখে যান আমাদের দৈনন্দিন জীবন...’ পোড়া ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে তেতো গালাগালের পরেও কাকুতি, ‘কেউ কি এক বারও দেখতে আসবে না?’ এই অকাল-বর্ষায় এই খণ্ডহর মাঠে এসে যে দাঁড়াবে, বৃষ্টিতে উদোম-মাথা শিশুদের দেখবে, সে কিছুতেই বলতে পারবে না, ভাঙো, ভেঙে ফেলো এমন এক দুরাশা দূর হচ্ছে না কিছুতেই।
রীতা পাত্র এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক দিল। দু’খানা পরীক্ষা হওয়ার পরই ঘর ভেঙে দিয়ে গিয়েছে পুলিশ। তার পর থেকে কেমন করে যে ফিলজফি, এডুকেশন, হিস্ট্রি, জিয়োগ্রাফি পরীক্ষা দিয়েছে সে রীতা-ই জানে। ‘বলছি না তো, যে যাব না। চলে যাব। কিন্তু আমার বইগুলোও নিয়ে চলে গেল কেন? এ ভাবে কেন ভেঙে দেবে ঘর?’
আর ক’জন এ প্রশ্ন করে, টিভিতে ওদের দেখে? রীতা, খোকন, সবিতা ওদের বস্তির নাম রেখেছে ‘মজদুর পল্লী,’ ছেলেমেয়েকে ব্যাগ কাঁধে পাঠায় ইস্কুলে, সযত্নে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে রাখে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ডের জেরক্স। ওরা বলে ওরা খেটে-খাওয়া লোক। বাকিরা জানে, ওরা কেস-খাওয়া পাবলিক, মিডিয়ার ক্যামেরায় যখনই আসে তখন সেই ফ্রেমে থাকে ভাঙচুর, আগুন, লাঠিচার্জ। হয় ওরা ভাঙচুর করে, পোড়ায় বাস-ট্রাম, দোকান-বাজার, নইলে পুলিশ ভাঙে ওদের ঘরবাড়ি, গুমটি-দোকান, হঠাৎ-আগুনে পোড়ে ওদের বস্তি। ওরা রাস্তা আটকে অবরোধ করে, ওরাই আটকে থাকে প্রিজন ভ্যানে, হাজতে। নেতারা কখনও ওদের সঙ্গে জেলে যায়, কখনও ওদের পোরে জেলে। হাওয়ার উপর ঘর, হাওয়া ঘুরলে ওদের ঘর তো ভাঙবেই।
ঘুরে যায় মানুষগুলোও। ২০০৪-০৫ সালে মেট্রো রেল তৈরির সময়ে বেলেঘাটা অঞ্চলের বাসিন্দারা ‘বৃহত্তর কলকাতা খালপাড় উচ্ছেদ বিরোধী কমিটি’ বানিয়ে প্রায় দু’বছর ধরে কনভেনশন, মিছিল, অবস্থান করেছিল। তার পর বামফ্রন্ট সরকার দিয়েছিল নোনাডাঙার ২২০০ ফ্ল্যাট। তার পর ‘গোবিন্দপুর রেল কলোনি বাঁচাও কমিটি’ শুরু হল আন্দোলন, পাওয়া গেল নোনাডাঙার আরও ১৬০০ ফ্ল্যাট। প্রতি বারই সদ্য-ফ্ল্যাটবাসীরা সরে যায় ঝুপড়িবাসীদের পাশ থেকে। কে খানদানি উদ্বাস্তু, কে উটকো, সে বোধ ওদের মধ্যে জাতপাতের মতোই প্রখর। এখন আবার পুট থেকে খেলা শুরু, এ বার ‘উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি কলকাতা’ ব্যানার পড়েছে। চলছে গণঅনশন। হয়তো ওরা ফ্ল্যাট পাবে। হয়তো মিলিয়ে যাবে। কয়েক মিটার দূরের মুণ্ডা পল্লি যেমন মুছে গিয়েছে।
রীতা পাত্র নেই অনশনের দলে। রীতা অন্তঃসত্ত্বা, সাত-আট মাস চলছে। ওর বাপ-মা থাকে ক্যানিং, আয়লা ঝড়ে তাদের বাড়ি ভেসে গিয়েছে, এক পয়সাও সাহায্য পায়নি। এ দিকে নোনাডাঙায় ক্লাস নাইন-পাস ড্রাইভার স্বামীর ঘরও ভাঙল। জমিটাই নাকি ঘিরে দেওয়া হবে কাঁটাতার দিয়ে। যার বাপের বাড়ি ভেসে গিয়েছে, স্বামীর ঘর পুড়ে গিয়েছে, কোথায় জন্মাবে তার সন্তান? কোন হাসপাতালের মেঝেতে, লোকাল ট্রেনের কামরায়, ফুটপাথে টানা শাড়ির আড়ালে?
উচ্ছেদ-মায়ের শিশু, কলকাতার যিশু। |
|
|
|
|
|