রাজা ও রাজনীতি যখন ক্ষমতা প্রদর্শনের অশ্বমেধ যজ্ঞে নামিতে চাহে, তাহার প্রিয়তম হাতিয়ার হয় শিক্ষাদান-পদ্ধতি। হীরকরাজ অকারণে শিক্ষামন্ত্রীকে শিক্ষাগুরুর পাঠশালা বন্ধ করিতে পাঠান নাই, তিনি বিলক্ষণ জানিতেন, মস্তক মুড়াইবার কাজটি যদি করিতে হয়, ধরিতে হইবে একেবারে গোড়া হইতে। এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও যখনই যে রাজা (কিংবা রানি) ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তিনি ও তাঁহারা সহর্ষে সপারিষদ ঝাঁপাইয়া পড়েন শিক্ষাক্ষেত্র-সম্মার্জনার আকর্ষণীয় কাজটিতে। তাহাতে এক ঢিলে দুইয়ের বেশি পাখি। বর্তমানে ক্ষমতা প্রদর্শনের কাজটি বুক ফুলাইয়া করা যায়। দুই, ভবিষ্যতের নাগরিকদের মস্তকমুণ্ডনের কাজটিও নির্ভুল ভাবে ছকিয়া ফেলা যায়। তিন, প্রিয় ও অপ্রিয় ব্যক্তিদের জন্য যথাক্রমে পুরস্কার ও তিরস্কারের হাতে-গরম বন্দোবস্ত করা যায়। এ জন্য উচ্চশিক্ষা কমিটি, পাঠক্রম কমিটি ইত্যাদির আবিষ্কার। শিক্ষার রাষ্ট্রীয়করণের বিশদ আয়োজন।
পাঠক্রম বিষয়টির সময়ানুগ সংস্কার একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়, সন্দেহ নাই। বাস্তবিক, এ দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি এতই জগদ্দল অতীত-বাহী যে তাহার যথেষ্ট সংস্কার কখন, কী ভাবে সম্ভব হইতে পারে, ইহাই এক বিরাট চিন্তার বিষয়। কিন্তু সেই চিন্তার দায় ও দায়িত্ব কে বহন করিবে, সেই সংস্কারের ধরনধারন কেমন হইবে, তাহা লইয়া সতর্ক পদক্ষেপ প্রয়োজন। সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি সংস্কারের সীমারেখা স্থির করা। নূতন নূতন ভাবনার দিগন্ত যেমন খুলিয়া দেওয়া দরকার, তেমনই প্রতিটি দিগন্তের সম্পূর্ণ মানচিত্র যাহাতে কোনও ‘একটি’ কমিটি কিংবা ‘একটি’ গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহাও দেখা দরকার। অর্থাৎ, সোজা কথা, ছাত্রছাত্রী কী পড়িবে, তাহা কত দূর প্রাক্-নির্ধারণ করা আদৌ সঙ্গত, সে বিষয়ে সতর্ক সচেতনতা জরুরি। ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো দেশে শিক্ষাপদ্ধতিতে একটি মুক্ত আদর্শ অনুসরণের ঐতিহ্য রহিয়াছে, যাহা এ প্রসঙ্গে অতীব প্রাসঙ্গিক। এই সব দেশে প্রতিটি স্তরের শিক্ষার একটি মোটামুটি ধারা ছকিয়া দেওয়া হয়, কিন্তু সেই পর্যন্তই। কোন লেখক বা কবির বই পড়িতে হইবে, তাহা লইয়া অঙ্গুলিনির্দেশ চলে না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষকের উপর অনেকাংশে তাহা ছাড়িয়া দেওয়া হয়। কোন স্তরে কোন সময়কার ইতিহাস পড়া হইবে, পাঠক্রমে তাহার একটি ধারণা দেওয়া হয়, কিন্তু কোন দেশের কোন বিপ্লব কোন ব্যক্তি কোন ঘটনা, তাহার বিশদ তালিকা বিদ্যালয়ের হাতে ধরাইয়া দেওয়া হয় না।
এই দেশে নানা কারণেই এতখানি বন্ধনহীনতা সম্ভব বা সঙ্গত না হইতে পারে। কিন্তু এতখানি সম্ভব নহে বলিয়াই যে কোনও স্বাধীনতাই দেওয়া যাইবে না, সরকার কিংবা সরকারি কমিটি নির্দেশিত পাঠ্যতালিকাই গ্রহণ করিতে রাজ্যের বিদ্যালয়কুল বাধ্য থাকিবে, ইহাও অর্থহীন। বিদেশের প্রসঙ্গ শিকায় থাকুক, এমনকী আমাদের দেশেও কিন্তু আই সি এস ই কিংবা সি বি এস ই বোর্ডের বিদ্যালয়গুলিতে এতটা বাধ্যবাধকতা নাই। কোন ক্লাসে কতখানি শেক্সপিয়র পড়া হইবে, কিংবা অডেন বা শেলি পঠিত হইবে কি না, উপরস্থ কোনও কমিটি এত শত খুঁটিনাটি না ভাবিয়া দিলেও নিচু হইতে উঁচু সমস্ত ক্লাসগুলিতে শিক্ষাদানের কাজটি যথেষ্ট সফল ভাবে সেখানে বাহিত হইতেছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ সরকার-চালিত বিদ্যালয়গুলিতেও রবীন্দ্রনাথ কখন ও কতটা, সুকান্ত কি না, বলশেভিক বিপ্লব না চিপকো আন্দোলন, ইত্যাকার খুঁটিনাটি নির্দেশ ছাড়াই শিক্ষাব্যবস্থা টিকিতে পারে কি না, পরখ করিয়া দেখা দরকার। যত বেশি খুঁটিনাটি নির্দেশ, তত বেশি কর্তৃত্বের ছায়া। আর, যত বেশি সরকারি নির্দেশ, ততই বেশি অগণতান্ত্রিক মস্তকমুণ্ডনের রমরমা। রাজনীতির প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি, প্রতিক্রিয়ায় আবার রাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রকে যদি এই দুষ্টচক্র হইতে মুক্ত করিতেই হয়, তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, পাঠক্রম লইয়া অতিরিক্ত মাতামাতি বন্ধ করা। পাঠক্রমকে একটি মোটের উপর গণ্ডিতে বাঁধিয়া সেই গণ্ডির মধ্যে তাহাকে বহুলাংশে মুক্ত ভাবে বিচরণ করিতে দেওয়া। |