হাতে হাতে মানুষের খুলি। খান আষ্টেক। আর তা নিয়ে দলে দলে শ্মশান সন্ন্যাসীদের নৃত্য। ২৯ চৈত্র ভোর। সে এক দেখার মতো ব্যাপার। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা অন্তত এমনটাই মনে করেন।
বৃহস্পতিবারও তাই ভিড় উপচে পড়েছিল কুড়মুনের শিবতলায়। গাজনের উৎসবে। মেলা চলবে সাত দিন।
বর্ধমান থেকে কুড়মুনের দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। গ্রামটি বর্ধমান-নবদ্বীপ রাস্তার ঠিক পাশেই। স্থানীয় দেবতা ঈশানেশ্বর ও তাঁর পুত্র গাজনেশ্বরকে কেন্দ্র করেই এই উৎসব।
ঈশানেশ্বরকে নিয়ে গ্রামে নানা গল্প প্রচলিত। শোনা যায়, সাড়ে তিনশো বছর আগে খড়ি নদীর কলমী সায়রের পাড়ে স্থানীয় বাসিন্দা সন্তোষ মণ্ডলের লাঙলে উঠে আসে ঈশানেশ্বরের মূর্তি। অনেকে আবার বলেন, স্বপ্নাদেশ দিয়ে দেবতা উঠে এসেছিলেন কলমী সায়র থেকে। এর পরে ঘোষালপাড়ায় খড়ি নদীর পাড়ে প্রাচীন মন্দিরে মনসা ও ষাড়েশ্বরের মূর্তির পাশেই বসানো হয় ঈশানেশ্বরের মূর্তিকে। পরে গ্রামের শিবতলায় স্থাপিত হয় নতুন মন্দির।
স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিত আশিস চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রতি বছর ১৩ চৈত্র কুড়মুনের ঘোষাল পাড়ার ঈশানেশ্বরের মন্দির থেকে মূর্তিটিকে নিয়ে আসা হয় গ্রামের পশ্চিম পাড়ার শিবতলার মন্দিরে। দেবতা এখানে ১৩ চৈত্র থেকে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত থাকেন। সারা বছর মূর্তিটিকে ঘি, দুধ আর জলে স্নান করানো হয়। চৈত্রের শেষ চার দিনের মধ্যে দু’দিন হয় নীল ও চড়ক পূজো।
সন্ন্যাসগ্রহণকারীরাও দু’ধরনের। এক দলকে বলা হয়ে শ্মশান সন্ন্যাসী আর অন্যেরা ফুল সন্ন্যাসী। ২৫ চৈত্র ভাগীরথীতে স্নান করে চলে সন্ন্যাস গ্রহণ পর্ব। শুধু কুড়মুন নয়, সন্ন্যাসী হন আশপাশের পাঁড়ুই ও পলাশির মানুষজনও। |
গ্রামের ঘোষাল পাড়ার ঈশানেশ্বরের মন্দিরে রয়েছে একটি মাতৃমূর্তিও। গ্রামের মানুষ তাঁকে ইন্দ্রাণী বলেন। মূর্তিটি কালো পাথরে খোদিত। উচ্চতায় দেড় ফুট। দুই হাত বিশিষ্ট দেবী হাতির পিঠে পা ঝুলিয়ে বসেন। পাশেই ছত্রধারী দন্ডায়মান অপর একটি মূর্তি। গ্রামবাসীদের দাবি, দেবী ইন্দ্রাণীর মূর্তিটি অতি প্রাচীন।
এই দাবির সমর্থনে ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ইন্দ্রাণী মূর্তি খুবই দুষ্প্রাপ্য। কেবল বাংলাদেশের রাজশাহী মিউজিয়ামেই রয়েছে এই মূর্তি। বিনয়বাবুর দাবি, কুড়মুনের ইন্দ্রাণী মূর্তিটি রাজশাহীর সংগ্রহশালায় থাকা মূর্তিটির চেয়েও প্রাচীন। বর্ধমানের কাটোয়া অঞ্চলে ইন্দ্রাণী নামে একটি প্রাচীন পরগনা ছিল। এই পরগনায় চামুন্ডা পূজাও প্রচলিত ছিল।
তবে কুড়মুনের ওই ইন্দ্রাণী মূর্তির বাঁ দিকটি কিন্তু প্রায় ৭০ বছর আগে তৎকালীন স্থানীয় পুরোহিতের হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। তবে তাতেও ওই মূর্তির মহিমা কিছুমাত্র কম হয়নি। গাজনের উৎসবে ঈশানেশ্বরের সঙ্গেই পুজো পান তিনি।
মেলায় হাজির কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা প্রতীপকুমার দেব। বললেন, “গ্রামে এসেই মানুষ প্রথমে যান মন্দিরে ঈশানেশ্বরের মূর্তি দেখতে। কারণ, সকলেই মনে করেন এই দেবতা মানুষের সমস্ত কামনা পূরণ করেন।” বাঁকুড়ার বাসিন্দা অরূপ নিয়োগী বলেছেন, “এই গাজন উৎসব প্রতি বছরই আমাকে টানে। বাঁকুড়ায় প্রচুর লোকসংস্কৃতির উৎসব আছে। তবু এখানকার গাজনের স্বাদই যেন আলাদা।” আপাতত সেই স্বাদেই এখন মাতোয়ারা দর্শনার্থীদের প্রাণ। |