আগের বার ওঁরা গেয়েছিলেন,
‘বন্দেমাতরম সবাই বল
ভোট দিতে এ বার চল
কংগ্রেস-তৃণমূলের মহাজোট হয়েছে ভাল।”
এ বার গাইছেন,
‘তোমার নাম মমতা। দেখালে দারুণ ক্ষমতা
পরিবর্তন কী এনেছ জানাও সে কথা
খুন-ধর্ষণ যথাতথা
বাংলায় আগুন জ্বলছে
পরিবর্তন বাংলায় এসেছে
লাল ঝান্ডা সবুজ হয়েছে।’
সুরটা বদলে গিয়েছে। |
গত কয়েক বছর ধরেই পৌরাণিক কাহিনীর বদলে সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে গান বাঁধছেন বোলান গাইয়েরা। গত বছর মে মাসে রাজ্যে পালাবদলের আগে তাঁদের গানের কলিতে উঠে এসেছিল পরিবর্তনের কথা। কেমন হল সেই পরিবর্তন? এ বার সেই প্রশ্নই তুলছেন, কখনও কখনও জবাবও দিচ্ছেন বোলান গাইয়েদের একাংশ।
রেল স্টেশন কিংবা বাসস্ট্যান্ড। কাটোয়ায় জমজমাট জায়গা দেখলেই এ বার বোলান গায়কেরা বলছেন
‘নারী ধর্ষণ যাচ্ছে বেড়ে
কাটোয়া-আমোদপুর রেলে
ছোট রেলগাড়ির ঘটনা
বিচার কর না, তোমরা
বিচার কর না।’
গান গাইবার সময় নানা চরিত্র ধরেন তাঁরা। আগের বার বোলান দলের ‘মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব’ বলেছিলেন,
‘সন্ত্রাস করে উন্নয়নকে
বন্ধ করা যায় না
হার্মাদ বাহিনী করছে
হামলা ঠেকাতে পার না?’
জবাব দিয়েছিলেন ‘মমতা’
‘তাপসী মালিক হত্যা
এটা তো নয় মিথ্যা!’
এ বার বোলান দলের ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা’-র গলায়,
‘সংবাদপত্র আমাদের বিরুদ্ধে করছে প্রচার
তার প্রতিকার করেছে সরকার।’
শেষ হতে না হতেই ‘জনতা’ গেয়ে ওঠেন,
‘এ বঙ্গে সমালোচনা চলবে না
জানাই গো ষোল আনা।’
বোলান দলের এক একটি দলে থাকেন তিন জন গায়ক। গান গাওয়ার সময় তাঁরাই এক একটি চরিত্র। কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো কেউ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মূলত শিবমন্দির বা শিবতলার আটচালায় রাতভর চলে বোলানের আসর। ফি-বছর বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া ও বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা শেষ চৈত্রে মেতে ওঠেন এই উৎসবে। |
বিভিন্ন শিবতলায় গান গেয়ে বেড়ান ‘দাঁড় বোলান’ শিল্পীরা। দলের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫। রাতভর হেঁটে তাঁরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গান শোনাতে যান। সঙ্গে থাকে বাঁশি, মাদল, হারমোনিয়াম, খোল-করতাল। আবার মুখে রং মেখে গাজনে যোগ নাচে ‘পোড় বোলান’-র দলও। হাতে তরোয়াল নিয়ে মাথার খুলি কখনও মুখে কখনও মাটিতে রেখে নাচতে নাচতে এক ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করেন তাঁরা।
লোক গবেষক তুষার পণ্ডিত জানান, রাঢ় বাংলায় ৩৫০ বছর আগে বোলান শুরু হয়। প্রথমে লোকের মুখে মুখে এই গান বাঁধা হত। ১৮৫০ সালের পর থেকে বোলান গান খাতায় লেখা শুরু হয়। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দের জন্যই রাঢ় বাংলায় এই বোলান গান জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর মতে, “রাজনীতি নিয়ে শ্লেষাত্মক গান শুনতে যে কোনও মানুষেরই ভাল লাগে। তাই বোলানের মত লোকগানেও তা চলে এসেছে।”
মুস্থুলি গ্রামের বাসুদেব ঘোষ, দেয়াসিন গ্রামের মিহির ধাড়ারা বলেন, “পরিবর্তনের পরে আমাদের রাজ্যের কী অবস্থা, তার উপরে গান তৈরি করা হয়েছে।” কী নেই তাতে! সাংবাদিকদের মারধর, পাহাড় ও জঙ্গলে শান্তি ফেরানো থেকে চাষিমৃত্যু, অধ্যক্ষ নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা, বাদ যায়নি কিছুই।
শুনে কেউ মুচকি হাসছেন, কেউ বলছেন ‘ঠিকই তো!’ এমনকী আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে মনপসন্দ গান লিখে দেওয়ার জন্য বোলান গান লিখিয়েদের বরাতও দিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলি।
বিরক্তও হচ্ছেন কি কেউ কেউ? গায়কেরা একবাক্যে বলছেন, “কী জানি! তবে গান গাইতে আগের জমানাতেও কেউ বাধা দেয়নি, এই জমানাতেও না।”
|
কাটোয়ায় ছবি দু’টি তুলেছেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। |