রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় • বাঁকুড়া |
দৃশ্য- ১। শিশু ওয়ার্ডে শৌচাগারের দরজার সামনে মৃত শিশু কন্যার দেহ আঁকড়ে কাঁদছেন মা। বাঁকুড়া ১ ব্লকের হিড়গ্রামের রফিকা বিবি অভিযোগ, “শয্যা পাইনি। তাই শৌচাগারের সামনে মেয়েকে নিয়ে শুয়ে ছিলাম। ঠান্ডা লেগে মেয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। অজান্তে মেয়ের সারা শরীরে পিঁপড়ে উঠে পড়ে। বারবার ডাক্তার নার্সদের জানিয়েও শয্যা পাওয়া গেল না। মেয়েটা চোখের সামনে মারা গেল।” কয়েক মাস আগে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এই দৃশ্য এখনও বদলায়নি।
দৃশ্য- ২। নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (নিকু)। যে সমস্ত শিশুরা জন্মের পরে অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত হয়, মূলত তাদেরই এই ইউনিটে রাখা হয়। নিকু-র ভিতরে ঢুকে দেখা গেল শিশুদের রাখার জন্য ছোট ছোট শয্যা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ শয্যায় দু’টি করে শিশুসন্তান রয়েছে। অভিভাবকদের আশঙ্কা, এ থেকে এক শিশুর রোগ অন্য শিশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। |
শয্যা কম। ভরসা মেঝে। ছবি: অভিজিৎ সিংহ। |
বাঁকুড়া জেলা তো বটেই, পাশাপাশি পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশ ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের কিছু এলাকার রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন। কিন্তু এখানকার শিশু ওয়ার্ডের পরিষেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আম জনতা। কয়েক মাস আগে পরিদর্শন করে কংগ্রেসের স্বাস্থ্য সেলের প্রতিনিধিরাও এই হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের পরিষেবা নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে কিছু অভিযোগ জানান। যদিও বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, রাজ্যের অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় এখানে শিশু-মৃত্যুর হার অনেক কম। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, এই হাসপাতালের পরিকাঠামো কি শুধুমাত্র শিশু-মৃত্যু হারের নিরিখেই মূল্যায়ণ করা হবে? উপরের ঘটনাগুলি কি হাসপাতালের মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিচার্য হবে না?
বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার পঞ্চানন কুণ্ডুর দাবি, “এখানে গড়ে প্রতিদিন ৩-৪টি শিশু মারা যায়। জন্মের সময় ওজন কম থাকা বা নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্ম নেওয়াই শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ। রাজ্যের অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় শিশু-মৃত্যুর হার এখানে অনেক কম।” তাঁর আরও দাবি, “ভাল ও উন্নত মানের চিকিৎসা হয় বলেই এখানে শিশু ভর্তির ভিড় অনেক বেশি।”
কিন্তু সেই ভিড় সামলানোর মত উপযুক্ত পরিকাঠামো কি আছে এই হাসপাতালে? হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, শিশু বিভাগে প্রতিদিন ১৮০-২০০টি শিশু ভর্তি থাকে। যদিও এখানে শয্যা রয়েছে ৫৭টি। হাসপাতাল সুপারের স্বীকারোক্তি, “প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা কম থাকায় অধিকাংশ রোগীকেই মেঝেতে শুতে হয়। শয্যার সংখ্যা তিন থেকে চারগুন বাড়ানো দরকার। স্বাস্থ্যভবনকে জানানো হয়েছে।” ‘নিকু’ ওয়ার্ডে মাত্র ১০টি শয্যা রয়েছে। সেখানেও রোগীর চাপ বেশি। তাই এই ওয়ার্ডের অধিকাংশ শয্যায় দু’জন করে শিশুকে রাখা হয়। এ ভাবে রাখলে শিশুদের মধ্যে কি সংক্রমণ ছড়াতে পারে না? সুপার বলেন, “সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু রোগীর এত চাপ সামলাতে গেলে এ ছাড়া কোনও গতি নেই।” তিনি জানান, এমনিতেই আমাদের হাসপাতালের এসএনসিইউ-তে (সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট) মাত্র ৩০টি শয্যা রয়েছে। ওই ওয়ার্ডের শয্যাগুলি ভরে গেলে বাকিদের ‘নিকু’তে পাঠানো হয়। ১৫ শয্যার আরও একটি ‘নিকু’ ওয়ার্ড চালু করা হবে।
এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেই-এর তালিকাও দীর্ঘ। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, এক জন শিশু শল্য চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তা সত্বেও ওই বিভাগ বন্ধ রয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। ওই বিভাগটি কেন চালু করা হচ্ছে না, তার সদুত্তর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেননি। সাধারণত একটু বেশি বয়সের শিশুদের শ্বাসকষ্ট বা অন্য কোনও ধরনের সমস্যা হলে অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিকু) চিকিৎসা করানো হয়। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে এখনও ওই ইউনিট চালু করা যায়নি। ফলে ওই শিশু রোগীদের সাধারণ শিশু বিভাগে ভর্তি রেখেই চিকিৎসা করানো হয়। সুপারের আশ্বাস, শীঘ্রই ‘পিকু’ ওয়ার্ড গড়ে তোলা হবে।
মাঝে মধ্যেই এই হাসপাতালে চিকিৎসার গাফিলতিতে শিশু মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের সঙ্কটজনক অবস্থা জানানো সত্বেও চিকিৎসকদের পাওয়া যায় না বলে তাদের পরিবারের অভিযোগ। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেকাংশে অভিযোগগুলি মানতে চাননি। কিন্তু বাস্তব হল, শিশু ওয়ার্ডে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালের শিশু বিভাগেরই এক চিকিৎসক স্বীকার করেছেন, “প্রয়োজনের তুলনায় শিশু বিশেষজ্ঞ কম রয়েছেন। বর্তমানে এখানে ২৪ জন শিশু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। কিন্তু দিন দিন শিশু বিভাগে যে পরিমাণে চাপ বাড়ছে, তাতে আরও অন্তত ১০ জন শিশু বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন।”
কর্তৃপক্ষের দাবি, দৈনিক গড়ে প্রায় ৬০টি শিশুর জন্ম দেওয়া হচ্ছে। যা রাজ্যের অন্য মেডিক্যাল কলেজগুলির তুলনায় বেশি। ফলে সে কারণে চাপ যথেষ্ট রয়েছে। হাসপাতাল সুপার বলেন, “স্বাস্থ্যভবনকে সমস্যার কথা জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মহকুমা হাসপাতালগুলির মান না বাড়ালে রোগী স্থানান্তিরত হয়ে রোগী আসা কমবে না। আমরাও ভাল পরিষেবা দিতে পারব না।” |