প্রবন্ধ ৩...
আমাদের অশ্রু
সব আমাদের জন্য
প্রথমে ছিল আমরি-তে আগুন, ৯৪টি প্রাণহানি, হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল, পাঁচ ডিরেক্টরের আত্মসমর্পণ, পরিচালন বোর্ডের দুই নামী ডাক্তার গ্রেফতার। তার পর পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ কাণ্ড। ‘সব সাজানো’, বললেন মুখ্যমন্ত্রী। তদন্তে গ্রেফতার হল তিন জন। প্রধান অভিযুক্তকে ধরতে তৎপর হল কলকাতা পুলিশ। দুটি কাহিনিই এখন পুরনো, বহুচর্চিতও। কিন্তু ঘটনা দুটির প্রেক্ষিতে যদি এই সমাজের দিকে এক বার ফিরে তাকাই, তা হলে একটা প্রশ্ন ওঠে।
লক্ষণীয়, পিঠোপিঠি দু’টি ঘটনার অভিঘাতে কলকাতার মধ্যবিত্ত ও বিদ্বজ্জনেরা খুব বিচলিত হয়েছিলেন। আমরি কাণ্ডে গ্রেফতারের পর বণিকসভার আবেদন ছিল, অপরাধী শাস্তি পাক, কিন্তু তদন্ত প্রক্রিয়ায় যেন পক্ষপাত না থাকে। একটি সংস্থা বলেছিল, এর ফলে দু’টি সম্প্রদায়ের দীর্ঘ ‘সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কে’ চিড় ধরার আশঙ্কা। মণি ছেত্রী’কে গ্রেফতারের পর গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা জানাল, পাহাড়ের মানুষ ব্যথিত।
ঠিকই, যতক্ষণ না দোষ প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দোষ বলেই গণ্য করতে হবে। এবং জামিন মঞ্জুর করাটা অভিযুক্তকে দয়া করে নয়, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া, জামিন তাঁর প্রাপ্য। এই নীতি মেনেই বিয়াল্লিশ বছর আগে সদর স্ট্রিট ডাকাতি মামলায় অভিযুক্ত সত্তর ছুঁই-ছুঁই স্বাধীনতা সংগ্রামী অনন্ত সিংহকে জামিন দেওয়া হয়েছিল, তেমনই কিছুকাল আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের ‘কুখ্যাত ৫০ সন্ত্রাসবাদী’ তালিকাভুক্ত ওয়াজলুল কামার খান’কেও জামিন দিয়েছিলেন মহারাষ্ট্র আদালত। আমরি কাণ্ডেও ধৃতরা জামিন পেতে শুরু করেছেন।
ধর্ষণ-কাণ্ডে আসা যাক। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র হিসাব (২০১০) অনুযায়ী ধর্ষণে এক নম্বর মধ্যপ্রদেশের (৩১৩৫) পরেই পশ্চিমবাংলা (২১৩৪), দিল্লি-মুম্বইয়ের পরেই কলকাতা, তবু আমরা ‘এ রকম তো কতই ঘটে’ বলে মেনে নিইনি।
এই সব সুস্থ সামাজিক বিবেকী লক্ষণ দেখতে দেখতে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। মণিবাবু জামিন পেয়েছেন খুবই ভাল কথা, কিন্তু উনি যদি এমন খ্যাতনামা ডাক্তার না হয়ে ৯৩ বছরের অবসরপ্রাপ্ত কোনও গ্রামীণ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বা বাঁকুড়ার কোনও ছোটখাটো সাবান কারখানার মালিক হতেন, তা হলেও কি করুণার আলোড়ন ঘটত আমাদের?
তদন্তের নামে দীর্ঘদিন ধরে আটক রাখা হয়েছে, জামিন মঞ্জুর হচ্ছে না, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। চণ্ডী সরকার (৬৭), হিমাদ্রি সেন রায় (৬৩), অজিত চক্রবর্তী (৭০) যথাক্রমে ২০০৫, ২০০৮ এবং ২০০৮ থেকে জেলবন্দি। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ইউএপিএ-তে ধৃত গৌর চক্রবর্তী (৭৭), অজিত ঘোষ (৬৫) অসুস্থ। এক-পা ভাঙা, এক-চোখ হারানো সুশীল রায় (৭৫) গিরিডি জেলে। এঁদের জন্য কি উতলা হই আমরা? বিখ্যাতদের মতো অখ্যাতদের ক্ষেত্রেও এক মাত্রার ঢোল-করতাল বাজুক, এমন বেআক্কেলে সাম্যবাদী প্রস্তাব চলে না, জানি। কিন্তু নিম্নগ্রামে হলেও কুপিত প্রতিবাদের কিছু প্রকাশ তো থাকা উচিত?
পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের সূত্রে আমাদের মনে পড়ে সেই তিন কলকাতানিবাসী মহিলার কথা, বানতলায় পৈশাচিকতা যাঁদের হনন করেছিল। কেন মনে পড়ে না মরিচঝাঁপির কাকসাভাইজোড়ী, বিজয়ভারিণী, কালীর চর গ্রামের জগদ্ধাত্রী-পারুলরানি-সবিতা-বিশাখা সহ সেই ২৩ জনের কথা, যাঁদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল পুলিশ? ‘হার্মাদ বাহিনীর’ অত্যাচারের বিরুদ্ধে শহর কাঁপানো তীব্র আলোড়ন-আন্দোলন হয়েছিল বলে যদি-বা কদাচিৎ কেউ বলে ওঠেন সিঙ্গুরের তাপসীর নাম কিংবা নন্দীগ্রামের রাধারানি আড়ি-র কথা, কিন্তু ঝাড়গ্রামের নিকটবর্তী সোনামুখী গ্রামের ললিতা মাহাত, কাজল মাহাত, রেখা মাহাত-সহ আট অসহায় আদিবাসী মহিলা যৌথবাহিনীর জওয়ানরা তাঁদের ৩০ জুন ২০১০ ধর্ষণ করেছে বলে যে অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের কথা কেন কেউ বলেন না? তাঁদের কোনও ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা না করেই তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেছিলেন ‘ঘটনার প্রমাণ মেলেনি’। এঁদের পাশে সিপিএম দাঁড়াবে না, জানা কথা, কিন্তু তৃণমূল বিদ্বজ্জন-সংবাদমাধ্যম কেউই মাথা ঘামাননি। তৃণমূল সাংসদকে চিঠি লিখে (৩ অগস্ট ২০১০) নিজেদের দুর্দশার কথা জানিয়েছিলেন ওঁরা। ফল হয়নি। কংগ্রেসের যুবনেত্রী উষা নায়ডু গিয়েছিলেন, কিন্তু দেখাতেই শেষ।
আমাদের সহানুভূতি-সমর্থন ‘সম্মাননীয়’ ব্যক্তিদের জন্য তোলা থাকে। প্রত্যন্ত গ্রামে ঘটে যাওয়া নারকীয়তার তুলনায় শহরের ঘটনা আমাদের মনোযোগ কাড়ে। আমাদের নির্মল অশ্রুমোচনে, পবিত্র ক্রোধের প্রকাশেও তবে স্পষ্ট শ্রেণিপক্ষপাত!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.