|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
সরকার কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারে না |
দুটি প্রশ্ন: শিশুমৃত্যুর হার কি এখন হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে?
এবং,
এর জন্য দায়ী কে—
অসচেতন জনসাধারণ,
না নিম্নমানের
সরকারি পরিষেবা? আলোচনা করছেন অরিজিতা দত্ত |
সাম্প্রতিক কালে শিশুমৃত্যুর খবর নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি যে ভাবে তোলপাড় হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। বি সি রায় হাসপাতাল, মালদহ জেলা হাসপাতাল, বাঁকুড়া সম্মেলনী মেডিক্যাল কলেজ এক বা দু’দিনের মধ্যে ১০ থেকে ১৯টি করে শিশুমৃত্যুর খবর এসেছে বারবার। অভ্যন্তরীণ তদন্তে দেখা গিয়েছে, শিশুগুলিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল বা শিশুগুলি অপুষ্টির শিকার ছিল। কোনও ঘটনাতেই কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের ত্রুটি ধরা পড়েনি। এখন তা হলে এ ক্ষেত্রে দু’টি প্রশ্নের উদয় হয়:
প্রথমত, শিশুমৃত্যুর ঘটনা কি আগে ঘটত না, না কি এখন শিশুমৃত্যুর হার হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে? সরকার পক্ষের দাবি যে, গত দশ মাসে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে অথচ বিরোধী পক্ষ এই শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলি উদ্ধৃত করে বলছেন, হার ঊর্ধ্বমুখী। আসল চিত্রটা কী?
দ্বিতীয়ত, শিশুমৃত্যুর জন্য দায়ী কে? আমজনতার ঔদাসীন্য ও সচেতনতার অভাব, না কি সরকারি পরিষেবার অবনমন?
|
শিশুমৃত্যুর হার |
সাধারণত শিশুমৃত্যুর হার বলতে আমরা বুঝি প্রতি এক হাজার জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মধ্যে কতগুলি শিশু তাদের বয়স এক বছর পূর্ণ হবার আগে মারা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০-এ শিশুমৃত্যুর হার ৩১, যা ভারতের গড় ৪৭-এর অনেক নীচে। গ্রাম ও শহরের এই হারের অনুপাত হল ১.৬৪। অর্থাৎ, শিশুমৃত্যুর হার গ্রামাঞ্চলে বেশি ঠিকই, কিন্তু গ্রাম-শহরের তফাতটা ভারতীয় গড় তফাতের অনেকটাই কম। আরও লক্ষণীয় যে, ১৯৯৭ থেকে ২০১০ এই বারো বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে ৪৩.৬ শতাংশ, আর ভারতে ৩৩.৮ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানের সূত্র হল এস আর এস (স্যাম্পেল রেজিস্ট্রেশন সার্ভে), যা রাজ্য স্তরে পাওয়া যায়, জেলা স্তরে নয়। এই তথ্য থেকে শেষ দশ মাসে কী পরিবর্তন হয়েছে, তা জানা যায় না। সরকারের কাছে যে মাসভিত্তিক হিসাব থাকে (হাসপাতালের রিপোর্ট আর আশা কর্মীদের রিপোর্ট থেকে), তা কিন্তু সব জনসাধারণ ধরে নয়, আর তাই তা অসম্পূর্ণ। অর্থাৎ, সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষ এদের কৃতিত্ব প্রদর্শন বা দোষারোপের পিছনে কোনও তথ্যের যাথার্থ্য থাকা অসম্ভব। |
|
তা হলে প্রশ্ন রয়ে যায় যে, শিশুমৃত্যুর ঘটনা বারবার শিরোনামে আসছে কেন? তা কি একান্তই সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনও ঘটনা? প্রথমত, এটা দ্রষ্টব্য যে, এই মৃত্যুর খবর আসছে বড় জেলা হাসপাতালগুলি বা মেডিক্যাল কলেজ থেকে, যেখানে অধিকাংশ শিশুই আসে দূরবর্তী গ্রাম থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য-মিশনের উদ্যোগে মানুষ আগের থেকে বেশি সচেতন হয়েছে, আর এটা সম্ভব হয়েছে অনুব্রতী স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের গুণেই। ফলে আগে যে অসুস্থ শিশুরা বাড়িতেই মারা যেত, সেগুলি অন্তত হাসপাতালে আসছে। এটা কিন্তু উন্নয়নের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর, একটি জেলা সদরে বারোটি শিশুর মৃত্যুর খবর সহজেই সংবাদমাধ্যমের নজরে আসে, প্রত্যন্ত গ্রামে দু’টি শিশুর মৃত্যু যেখানে সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আবার জেলা হাসপাতাল বা তার উপরের হাসপাতালে অনেক বেশি শিশু ভিড় করে ভাল চিকিৎসক ও অন্যান্য সুবিধাগুলি পেতে। স্থানীয় হাসপাতালে না গিয়ে অসুস্থ শিশুগুলিকে নিয়ে অভিভাবকরা চলে আসেন উচ্চতর হাসপাতালে, যেখানে স্থান অকুলান। সরকারি রেফারেল ব্যবস্থা যেখানে একটি প্রহসন মাত্র, সেখানে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত অভিভাবকদের এই প্রচেষ্টা মাঝে মাঝে অঘটনের সাক্ষী হয়।
|
আমজনতার দোষ? |
এ বার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। সত্যিই কি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যবহারিক পদ্ধতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমস্যার বীজ? এ কথা সত্যি যে, পশ্চিমবঙ্গের মোট ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের মধ্যে ২৪ শতাংশই গর্ভধারণ শুরু করে, যেখানে সর্বভারতীয় গড় হল ১৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের থেকে বেশি কিশোরী মায়ের অংশ আছে একমাত্র ঝাড়খণ্ডে। আরও সাংঘাতিক হল মুসলিম ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের ৩০ শতাংশ কিশোরীর গর্ভধারণ। কিশোরী মায়েরা অধিকাংশই রক্তাল্পতায় ভোগে ও তাদের শরীরও সন্তানধারণের জন্য প্রস্তুত থাকে না। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশুর, যারা প্রথম থেকেই নানান সংক্রামণের দ্রুত শিকার হয়। শিশুর জন্মের সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী বা দাইমা থাকলে সংক্রমণ কম হয়। কিন্তু প্রশিক্ষিত কর্মী উপস্থিত থাকেন হিন্দু শিশুদের ৬১ শতাংশের ক্ষেত্রে এবং মুসলিম শিশুদের মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। এই দুই ঘটনার ফল-- শিশুমৃত্যুর হার ২০ বছরের কম বয়সি মায়েদের ক্ষেত্রে হয় ৬৮.৪, ২০ থেকে ২৯ বয়সি মায়েদের জন্য ৪৫ এবং ৩০ থেকে ৩৯ বছরের মায়ের ক্ষেত্রে ৩২ (জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০০৪-০৫-এর তথ্য অনুযায়ী)।
অনুন্নত সম্প্রদায় ও তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যবহারের ভিত্তিতে তিনটি জেলা এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য উত্তর দিনাজপুর, মালদহ ও মুর্শিদাবাদ। সারণি থেকে দেখা যায় যে, এই দুই জেলায় অনুন্নত সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা খুব বেশি (পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক), এখানে মাতৃত্বের অনুপাতও বেশি। স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতিতে শিশুর জন্মের হারও খুব কম। মহিলা সাক্ষরতার হার কম হওয়ায় এই মায়েরা হয়তো খুব ভাল শিশুযত্ন দিতেও পারেন না। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই জেলাগুলিতে দুর্বল শিশুর জন্ম ও গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। উদাহরণস্বরূপ, মুর্শিদাবাদের একটি অনুন্নত ব্লকে ২০১১-র অক্টোবর মাসে ২৬টি শিশুর মৃত্যু হয় (১৯টি বাড়িতে ও ৭টি হাসপাতালে), যদিও খবরটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে হুড়োহুড়ি পড়েনি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, পশ্চিমবঙ্গ হল সারা ভারতে একমাত্র রাজ্য, যেখানে ২০০৪-০৬ ও ২০০৭-০৯ সময়ে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। জন্মের সময়ে মায়ের মৃত্যু ও সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক থাকতে বাধ্য।
|
সরকারের কি কিছুই করার নেই? |
জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার অভাব মেনে নেওয়া মানে কি সরকারের কোনও দায়িত্ব নেই? উত্তরটা বোধ হয় নঞর্থক। ‘উল্লম্ব সমতা’ বা ‘Vertical Equity’-র তত্ত্ব বলে, যেখানে প্রয়োজন বেশি, সরকারের দায়িত্বও সেখানে বেশি। এই জেলাগুলিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তর হাসপাতালের শয্যা খুব কম। উপরন্তু মালদহের মতো বড় জেলায় কিছু দিন আগে পর্যন্ত হাসপাতাল ছিল মাত্র একটি। চাঁচল মহকুমা হাসপাতাল ২০১১-য় তৈরি হলেও অধিকাংশ পরিষেবা পাওয়া সেখানে দুষ্কর। জেলাগুলিতে ব্লক হাসপাতালে স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ অপ্রতুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লেবার রুম পর্যাপ্ত নয়, স্বাস্থ্য উপকেন্দ্রে অনুব্রতী স্বাস্থ্যকর্মী সদ্যোজাত শিশুর অসুখ বিষয়ে ট্রেনিং পান না। পরিষেবা খুবই নিম্নমানের।
এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থাকে ডাক্তার-নার্সদের অনুপস্থিতি। যেখানে তাঁদের সপ্তাহে এক দিন ছুটি থাকার কথা, নিজেদের মধ্যে ‘রোস্টার’ তৈরি করে তাঁরা দুই-তিন দিন অনুপস্থিত থাকেন। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ‘কল বুকে’ ডাক্তারবাবুকে বাড়ি থেকে আনার ‘পুলকার’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাঁরা যখন হাসপাতালে থাকেন, রোগীর চাপ থাকে অনেক বেশি ও তাতেই হয় গুণমানের বিপত্তি।
কিশোরী মাতৃত্বের এই সমস্যাও এ দেশে বা রাজ্যে নতুন নয়। স্বাধীনতার ষাট বছর অতিক্রান্ত হবার পরও শুধুমাত্র তাদের জন্য কোনও পরিকল্পনা নেওয়া হল না কেন? শিশু ও নারী উন্নয়নের দফতর আর স্বাস্থ্য দফতর কেন সমান্তরাল দু’টি অংশ হয়ে রইল? সরকারের তরফে কোনও সুসংহত পরিকল্পনার কথা ভাবার সময় এখনও কি আসেনি? এই তিনটি জেলাকে সামনে রেখে বিশেষ নীতি নেওয়ারও প্রয়োজন বড় বেশি। সংরক্ষণ শুধু ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ না করে ‘সমষ্টিকেন্দ্রিক’ করতে রাজ্যের পিছিয়ে পড়া ব্লক বা অঞ্চলগুলিতে সমস্ত ‘পাবলিক গুড’ সুসংহত ভাবে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাই একমাত্র এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে।
|
ভরসা ও বিশ্বাস |
সবশেষে আসি এই প্রসঙ্গে যে, শিশুর আত্মীয়রা দেখা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তার বা নার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন কাজে গাফিলতির। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেন, শিশুটিকে আনাই হয়েছিল মৃতপ্রায় অবস্থায়। আসলে সমস্যাটা দুই জায়গায়। এই রাজ্যে ভারতের গড়ের তুলনায় অনেক বেশি শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতালে আসেন। হাসপাতাল এবং তার সমস্ত পরিকাঠামো তাই এ রাজ্যে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। আবার, সমকালীন একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রোগীরা এখানে সরকারি হাসপাতালে আসেন শুধু শস্তা বা একমাত্র সম্ভব পরিষেবার জন্য নয়, আসেন এক জায়গায় অনেক প্রকার পরিষেবা পেতে এবং তাঁদের মধ্যে এখনও অনেকে মনে করেন যে এই হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের গুণমান খুব ভাল। অতএব প্রত্যাশা থাকে অঢেল, কিন্তু ভরসা থাকে নড়বড়ে। নার্স ও গ্রুপ-ডি কর্মচারীর রুক্ষ ব্যবহার, সঙ্গে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগের অভাবে অভিযোগের আঙুল ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট, মুখ্যমন্ত্রী তথা জনপ্রিয় নেত্রীর আশ্বাসবাণী সব কিছুই মিথ্যা বলে মনে হয়। তাই এই দোষারোপের প্রবণতা কমাতে সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মীর নিজেদের আর এক বার প্রমাণ করার সময় এসেছে। এই অগ্নিপরীক্ষায় তাঁদের দেখাতে হবে, সত্যিই তাঁরা রোগীর আত্মার আত্মীয় ভগবান নন, কিন্তু সমব্যথী, সংবেদক ও সহমর্মী। তখনই আমজনতা বুঝবেন যে, এই অঘটন ডাক্তারদের ঔদাসীন্যের জন্য নয়, অনেকটা কাজ তাঁদেরও ছিল। আর তখনই আসবে তাঁদের দিকে সচেতনতায় পরিবর্তন। আর এই কাজটা স্বাস্থ্যকর্মীরা কী ভাবে করবেন, এ উত্তর তাঁরাই দেবেন।
|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|