বরিশাল শহর ছেড়ে ঠিক স্বাধীনতার বছরেই কলকাতায় চলে আসে একটি চোদ্দো বছরের ছেলে রোগা লাজুক, দারুণ রকমের বই-পড়ুয়া। তখনই হয়তো বোঝা যায়নি যে, এই ছেলেটি বাংলা সাহিত্যের জন্য বলিপ্রদত্ত। সারা জীবন সে বাংলা সাহিত্যের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। কবিতা লেখা থেকে শুরু, সিটি কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ার সময় সে একটা ছোটখাটো কবিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তখন কৃত্তিবাস পত্রিকাকে ঘিরে এই গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। মোহিত চট্টোপাধ্যায় চলে আসে তার সামনের সারিতে। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তাকে বিশেষ খ্যাতিমান করে তোলে।
ছাত্রজীবন শেষ করার পর কবিদের কোনও না কোনও জাবিকা নিতেই হয়। দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের। অধিকাংশ কবিই স্কুল বা কলেজে পড়াবার খোঁজে, কেউ বা ঢুকে পড়ে সংবাদপত্রের অলিন্দে। সংবাদপত্র অনেক সময় গিলে ফেলে কবিকে। শিক্ষকতা বা অধ্যাপনাও অনেক সময় কবিকে করে তোলে গদ্যময়। সারা জীবন সাহিত্যকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকা খুব শক্ত ব্যাপার। কিন্তু মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের তো উপায়ও নেই, ইচ্ছে করলেও সে সাহিত্য থেকে সরে যেতে পারেবে না।
অধ্যাপনার কাজের মধ্যেও কবিতা লিখতে লিখতে সে এক সময় ঝুঁকে পড়ে নাটকের দিকে। তার প্রথম নাটক, ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’। এক সময় সে কবিতা খুব কম লিখে নাট্য রচনাতেই মনোযোগ দেয় বেশি। সেই সময় তার কবি বন্ধুরা অনেকেই আফসোস করে বলত, বাংলা কাব্যজগৎ এক জন প্রতিভাবান কবিকে হারাল। আমিও সে রকমই ভেবেছিলাম। পরে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের এই রূপান্তর তার ব্যক্তিগত সাফল্যের চেয়েও অন্য দিকে এক বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে।
সেই ষাট সত্তরের দশকে বাংলা নাটকের অবস্থা কী ছিল? উত্তর কলকাতার পেশাদারি নাট্যদলগুলো টিমটিম করছে কিংবা ভেঙে পড়ছে। আর অন্য দিকে, বিপুল উদ্দীপনায় শুরু হয়েছে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। নতুন আঙ্গিক, আধুনিক চিন্তাধারা, বিষয় অনুযায়ী মঞ্চসজ্জা, অতি-নাটকীয় কিংবা গলাকাঁপানো অভিনয় ধারার পুরো পরিবর্তন। কিন্তু কী নাটক তারা মঞ্চস্থ করছে। হয় রবীন্দ্রনাথ অথবা কোনও প্রকাশিত উপন্যাসের নাট্যরূপ। অথবা কোনও বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ। তৃতীয়টাই বেশি। |
রঙ্গপট প্রযোজিত ‘তথাগত’ নাটকের একটি দৃশ্য |
এক সময় বের্টোল্ট ব্রেখটের দুটি নাটক একই সঙ্গে মঞ্চস্থ করছিল দুটি দল। মৌলিক বাংলা নাটক কোথায়? শিশিরকুমার ভাদুড়ী মাঝে মাঝে হাহাকার করতেন, নতুন সার্থক বাংলা নাটক তিনি পেলেন না। অতিশয় দুর্বল কিছু নাটকে তাঁর অভিনয়-প্রতিভা নষ্ট হয়েছে।
বিদেশি নাটককে বাংলার ঘরে আনা দোষের কিছু নয়। তাতে আমাদের নাট্যজগৎই সমৃদ্ধ হয়। তবে একটাও মৌলিক নাটকের দেখা নেই। শুধু নির্ভর করতে হবে বিদেশি নাটকের উপর? এ রকম অবস্থা লজ্জাজনক নয়? এই সময় মোহিত চট্টোপাধ্যায় একটার পর একটা নাটক লিখতে শুরু করে। তার প্রথম দিকের কয়েকটি নাটকের সংলাপে একটু বেশি বেশি কাব্যিক ভাব থাকলেও অচিরেই সে নতুন ভাষা আয়ত্ত করে। তার নাটকগুলো মঞ্চে সাফল্য পায়। নাট্যকার হিসেবে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সাফল্য যত না ব্যক্তিগত, তার চেয়েও বেশি ছিল বাংলার নাট্যজগতে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন যোগ্য নাট্যকারকে পাওয়া।
অবশ্য শুধু মোহিত নন, প্রায় একই সময়ে নাট্য রচনা শুরু করেন বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, রমাপ্রসাদ বণিক, ব্রাত্য বসু এবং আরও কয়েক জন। এখন দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়, বাংলা নাটকের দৈন্যদশা কেটে গেছে। আমরা বেশ কিছু সার্থক, স্মরণীয় বাংলা মৌলিক নাটক পেয়েছি।
মোহিতের নাটকের সংখ্যা একশোর এদিক-ওদিক। বিষয় বৈচিত্রেও উপভোগ্য। তার সাম্প্রতিকতম নাটকটির নাম তথাগত। ‘রঙ্গপট’ প্রযোজিত এই নাটকটি দেখতে যাওয়ার আগে মনে আশঙ্কা ছিল, মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ব না তো? মহাপুরুষদের জীবন আলেখ্য নিয়ে এই সংশয় থাকতেই পারে। কারণ, ঘটনাগুলো আমাদের জানা। গৌতম বুদ্ধের জীবনীতে তেমন কোনও টানাপোড়েন নেই, উচ্চকণ্ঠ নেই, রোমান্টিক দৃশ্যের অবতারণার সুযোগ নেই। এখানেই মোহিতের প্রধান কৃতিত্ব এই যে, এমন একটি শান্ত রসের নাটকেও আমাদের মনোযোগ এক বারও বিচলিত হয়নি। বুদ্ধের ভূমিকায় ডাক্তার তপনজ্যোতি দাস একই সঙ্গে সংযমী ও দৃঢ়। অন্যরাও বিশ্বাসযোগ্য। শেষ দৃশ্যটি অবিস্মরণীয়।
মোহিত এখন বেশ অসুস্থ। সে নাকি বলেছে, এত পরিশ্রম করে এ রকম পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা তার ইহজীবনে আর সম্ভব হবে না। এই শেষ নাটকটিই তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক! তিনি অবিলম্বে সুস্থ হয়ে উঠুন, এ রকম আশা করা যেতেই পারে। তার চেয়েও বড় কথা, এমন কঠিন রোগকেও সহ্য করে শক্তি অর্জন করা।
মোহিতের কবিতার এক টুকরো নিদর্শন:
|
বুকের ওপর একটা খবরের কাগজ পড়ে আছে
লোকটি খবরের কাগজ চাপা পড়ে মরে যায়নি তো?
কাগজের চেয়ে খবরের ওজন কোটিগুণ ভারি!
অথচ গল্পের একটা ফল দেখুন
একটা কথা পর্যন্ত না বলে ধীরে ধীরে রসে ভরে ওঠে।
ভালোবাসা পেলেই না সুন্দর সহজ হাঁটা
ইচ্ছা সুখের ছায়া পড়বে
বুকের মধ্যে গোপন পাখি ডানা মেলে
বাইরে আসবে। মুঠোর মধ্যে আয়না ধরো।
দু’হাত মেলে বাতাস ধরো— উড়ে যাবে। |
|
(কমল সাহা রচিত ‘হৃদয়ের থেকে ভালো বাসভূমি নেই’ গ্রন্থ থেকে কিছু তথ্য সংগৃহীত।) |