প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী নেই। ডাক্তারেরও অভাব। পরিকাঠামোর এ হেন নানা খামতি সত্ত্বেও স্রেফ সদিচ্ছার জোরে প্রসব-সংখ্যার বিচারে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় (পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রথম তো বটেই) স্থান দখল করল চন্দ্রকোনা গ্রামীণ হাসপাতাল। গত আর্থিক বছরে রাজ্যের ব্লক ও গ্রামীণ হাসপাতালগুলির কাজকর্ম নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের পরিবারকল্যাণ বিভাগের বিচারেই এই শিরোপা। যে কারণে সম্প্রতি চন্দ্রকোনার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আড়াই লক্ষ টাকা পুরস্কারও দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। সাধারণ ও সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) মিলিয়ে চলতি বছরে আরও ভাল পারফরম্যান্সের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে উৎসাহিতও করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।
হাসপাতালের সুপার গোপাল দে-র মন্তব্য, “আমাদের এখানে ডাক্তার-নার্স এবং বিভিন্ন স্তরের কর্মীর বড় অভাব। তা সত্ত্বেও আমরা এই পুরস্কার পেয়েছি আন্তরিকতার জোরে। চেষ্টা করছি যাতে চলতি বছরে রাজ্যের মধ্যে প্রথম হতে পারি।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্র-রও বক্তব্য, “ডাক্তার ও কর্মীর অভাব থাকা সত্ত্বেও চন্দ্রকোনা এই শিরোপা পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে থাকলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিষেবার মান বাড়ানো যায়।” |
চন্দ্রকোনা-২ ব্লক এবং চন্দ্রকোনা পুর-এলাকার বাসিন্দাদের পরিষেবা দেওয়ার জন্যই এই গ্রামীণ হাসপাতাল। তবে সংলগ্ন কেশপুর, চন্দ্রকোনা-১, গড়বেতা-১ ও ৩ ব্লকের বাসিন্দারাও ৬০ শয্যার এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। দু’জন স্ত্রী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ থাকার অনুমোদন থাকলেও রয়েছেন মাত্র এক জন। এক জন মাত্র অ্যানাস্থেসিস্ট। তাঁকেও সম্প্রতি সপ্তাহে দু’দিন করে ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে ডিউটি করতে যেতে হয়। ফলে ওই দু’দিন ভর্তি রোগীর সিজারের প্রয়োজন হলে ‘রেফার’ করা ছাড়া গতি থাকে না। ওটিতে নার্সেরও অভাব সর্বক্ষণ। ভগ্নপ্রায় আবাসন। কিন্তু হাসপাতাল ছেড়ে না গিয়ে কয়েক জন মাত্র ডাক্তার-নার্স-কর্মীই রোগীর জন্য প্রাণপাত করেন বলেই এসেছে সাফল্য।
স্বাস্থ্য-দফতর সূত্রের খবর, যাতে পরিষেবা ঠিকঠাক এবং প্রসব বেশি সংখ্যায় হয়, সে জন্য উৎসাহ দিতেই পরিবারকল্যাণ বিভাগ ব্লক ও গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে সমীক্ষা চালিয়েছিল। সরকারি নির্দেশ ঠিকঠাক মানা হলে এবং পরিষেবার মান ভাল হলে আর্থিক পুরস্কার ছাড়াও দেওয়া হয় সার্টিফিকেট। চন্দ্রকোনা গ্রামীণ হাসপাতাল সূত্রের খবর, ২০১০-’১১ আর্থিক বছরে এই হাসপাতালে প্রসব হয়েছিল ১৮৯৭ জনের। ২০০৯-২০১০ সালে হয়েছিল ১৭৪৮ জনের। আশি ভাগ প্রসবই সাধারণ (‘নর্মাল ডেলিভারি’)। যা বেসরকারি ক্ষেত্রের ঢালাও অস্ত্রোপচারের বিপরীতে আশার আলো। মাত্র কুড়ি শতাংশের ক্ষেত্রে ‘সিজার’ (অস্ত্রোপচার) করতে হয়েছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্রবাবুর মন্তব্য, “এক জন মাত্র ডাক্তার নিয়ে এই সাফল্য অন্যদের ক্ষেত্রে উদাহরণ তো বটেই।” |
সেই সবেধন নীলমণি স্ত্রী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ গৌতম প্রতিহার একা কৃতিত্ব নিতে চান না। তাঁর কথায়, “সব কর্মী মিলে পরিশ্রম করেছি বলেই হাসপাতালের স্বীকৃতি এসেছে। আগামী দিনে আরও ভাল পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করব।” এত জন প্রসূতির প্রসব ও চিকিৎসা সামলাতে সমস্যা হয় না? ‘ব্যতিক্রমী’ ডাক্তারবাবু গৌতমবাবুর জবাব, “প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে কেউ ভর্তি হলে তাঁকে কি ফেরানো যায় না রেফার করা সম্ভব! যত অসুবিধাই থাকুক সাধ্যমতো চেষ্টা করি।” লেবাররুম বা ওটির বাইরে আউটডোরেও রোগী দেখার ক্ষেত্রে ক্লান্তি নেই এই ডাক্তারবাবুর, জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারাই।
হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারবাবু, নার্স, কর্মীদের প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন চন্দ্রকোনার সীতানগরের বাসিন্দা, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জিতেন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “সম্প্রতি আমার এক আত্মীয় ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রতিদিনই হাসপাতালে যেতাম। রাতেও থেকেছি। কর্মীর অভাব থাকলেও কাউকে বিরক্ত হতে দেখিনি।” চন্দ্রকোনা রোডের বেনাচাপড়ার তনুবালা মান্ডি গত মাসে ভর্তি হয়েছিলেন প্রসব-যন্ত্রণা নিয়ে। তাঁর অভিজ্ঞতা, “সিজার হয়েছিল। আমার রক্তচাপ বেশি থাকায় ডাক্তারবাবু এবং দিদিমণিরা রাতে বার বার দেখতে এসেছিলেন।” আঁধারনয়নের সাবিনা বিবি, চন্দ্রকোনার পাপিয়া দোলইরাও বলেন, “আমরা দু’দু’বার ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম।
দেখেছি খুব সমস্যা না হলে ডাক্তারবাবুরা কাউকে রেফার করেন না।”
সরকারি শিরোপার চেয়েও রোগী ও তাঁদের পরিজনেদের এই বাহবাকেই বড় পুরস্কার মনে করেন গোপাল, গৌতমবাবুরা। স্বপ্ন দেখান এই আকালেও।
|
ছবি তুলেছেন রামপ্রসাদ সাউ। |