প্রশ্ন উঠছে পুলিশি দক্ষতা নিয়ে |
|
পরপর চুরি-ডাকাতিতে
সন্ত্রস্ত নাগরিক জীবন
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
কখনও নিশানা, ফাঁকা পড়ে থাকা গৃহস্থের বাড়ি। কখনও লক্ষ্য, অরক্ষিত সোনার দোকান বা পাড়ার ছোট মন্দিরের বিগ্রহের গয়না। রাত-বিরেতে পর্যাপ্ত রক্ষীবিহীন ছোট কারখানাও বাদ পড়ছে না।
নতুন বছরের আগে থেকেই কলকাতা, হাওড়া ও দুই ২৪ পরগনার লাগোয়া এলাকায় পরপর লুঠপাটের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলার সামগ্রিক হাল নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল।
বাঙুর অ্যাভিনিউয়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে চুরির খবর জানাজানি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত ভাবে বেশ কয়েকটি লুঠের ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ শহরতলির হরিদেবপুর বা হাওড়ার বাউড়িয়ায় ফোর্ট গ্লস্টার বাজারের সোনার দোকান কিংবা বারাসতের সাইবনার হোসিয়ারি কারখানা কি বালিতে জিটি রোডের ধারের পুরনো মন্দির সর্বত্র পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েই কাজ সেরে পালিয়েছে লুটেরা-বাহিনী। আম-নাগরিকের অভিজ্ঞতা বলছে, পুলিশি ‘নজরদারি’র খামতির সুযোগ নিয়েই ‘অরক্ষিত’ এলাকায় এ ভাবে অবাধে দুষ্কর্ম ঘটে চলেছে।
ফলে প্রশ্ন উঠছে, অপরাধের মোকাবিলায় পুলিশের সোর্স-নেটওয়ার্কের কার্যকারিতা নিয়ে। সামগ্রিক ভাবে পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজা ছাড়াও এলাকা-ভিত্তিক দুষ্কর্মের মোকাবিলায় পুলিশ কতটা সক্রিয়, তা নিয়ে নাগরিক থেকে পুর-প্রতিনিধি, সব মহলেই সংশয় দেখা দিচ্ছে।
অথচ, সাত মাস আগে রাজ্যে বাম-জমানার পালাবদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে এলাকাগত ভাবেই অপরাধ কমানোর লক্ষ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছেন। রাজ্যে বেশ কয়েকটি কমিশনারেট গঠনের পিছনেও ছিল ছোট ছোট এলাকার উপরে নজরদারি আঁটোসাঁটো করা। কলকাতা লাগোয়া বেহালা-ঠাকুরপুকুর-গড়িয়া-পাটুলিকে কলকাতা পুলিশের এলাকার অন্তর্গত করার পিছনেও ওই তল্লাটে নজরদারি বাড়ানোর যুক্তিই তখন কাজ করেছিল।
বাস্তবে অবশ্য পুলিশের ‘সাফল্য’ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকছে। লালবাজারের এক কর্তাও মানছেন, “এটা ঠিকই যে, সংযুক্ত এলাকায় খুচখাচ কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে। তবে এর পিছনে সংগঠিত চক্র নেই। কুলতলি, ক্যানিং, জয়নগর, বারাসত, বনগাঁ এলাকার বিক্ষিপ্ত কিছু ‘গ্যাং’ কলকাতায় ঢুকে এ সব ঘটাচ্ছে।”
উল্টো দিক থেকে অপরাধের পিছনে এই সংগঠিত চক্র না-থাকাটাই যে পুলিশের বিরাট মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে, তা প্রকারান্তরে মানছেন রাজ্য পুলিশের আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও। সঞ্জয়বাবুর কথায়, “এটা ঠিকই যে, অপরাধের কোনও নির্দিষ্ট কৌশল বা ‘মোডাস অপারেন্ডি’ থাকলে পুলিশের কাজটা সোজা হয়। তবে ইদানীং যা ঘটছে, তা বিশ্লেষণ করেও অপরাধ ঠেকানোর চেষ্টা চলছে।”
এ যাত্রায় বারাসতে বেশ কয়েকটি ঘটনায় লুঠপাটের পিছনে ম্যাটাডর-বাহিনীর হাত দেখা গিয়েছে। এ দিন সকালে সাইবনার গেঞ্জি কারখানা ছাড়াও টাকির পিরগাছায় তারের কারখানা, বাদুর একটি স্কুলে কম্পিউটার সরানোর ঘটনা বা আমডাঙার মিরহাটির একটি তারের কারখানায় একই কায়দায় লুঠপাট হয়েছে। একমাত্র মিরহাটিতে তিন জন দুষ্কৃতীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
পরপর লুঠপাটে অবশ্য পুলিশের প্রতি আমজনতার ‘আস্থা’ চিড় খাচ্ছে। বাঙুরের বাসিন্দা সুপ্রকাশ ঘোষের কথায়, “যা দিন-কাল, তাতে উইক-এন্ডে বাড়ি খালি রেখে দু’দিনের জন্য কোথাও যেতেও ভরসা পাচ্ছি না।” বাঙুরের কাউন্সিলর মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যেরও পুলিশে ভরসা নেই। তাঁর কথায়, “আমরা বরং এ তল্লাটে গলি কমিটির পাহারাদার বাড়াতে চেষ্টা করছি।”
আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সল্টলেকে অপরাধ বাড়লেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে পুলিশ কী ভাবে তার মোকাবিলা করেছে। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন-শৃঙ্খলা) সুরজিৎ করপুরকায়স্থ অবশ্য বলছেন, “অনেক ক্ষেত্রেই কোনও এলাকায় লুঠপাট বেশি ঘটলে অঞ্চল-ভিত্তিক বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কল্যাণী বা সল্টলেকে কিছু দিন আগে এমন হয়েছে। এ বারও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে।” সঞ্জয়বাবুর বক্তব্য, “এখনও লেকটাউন, রাজারহাট বা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল নিয়ে আমাদের বিশেষ ভাবনা রয়েছে।”
পুলিশের এ সব দাবি সত্ত্বেও লেকটাউন, বাঙুর, দমদম পার্ক, দমদম, রাজারহাটে চুটিয়ে মোটরবাইক চুরির ঘটনা বাড়ছে। ভরসন্ধ্যায় লেকটাউন ফুটব্রিজে মহিলাদের হার ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ শহরতলিতে সোনারপুর ও গড়িয়ায় দু’টি ডাকাতির ঘটনায় রাজু গাজি নামে এক দুষ্কৃতীকে পুলিশ এ দিন গ্রেফতার করে।
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডেও মানছেন, কমিশনারেট হওয়ার পরে গত চার মাসে যানশাসনের দিকটায় উন্নতি হলেও আইন-শৃঙ্খলার কয়েকটি সমস্যা এখনও বহাল রয়েছে। রানাডের কথায়, “প্রোমোটার-চক্র বা তোলাবাজদের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা বা খুন এখনও হচ্ছে। এটা হাওড়ার পুরনো সমস্যা। তবে লুঠপাটের ঘটনা কয়েক মাসে কিছুটা কমেছে।” |