তিনের জোরে রাজ্যে কংগ্রেস ফের প্রাসঙ্গিক
প্রথমে ধান-পাটের সহায়ক-মূল্য ও সারে ভর্তুকির দাবি। তার পর ইন্দিরা ভবনের নামবদল। সবশেষে রায়গঞ্জ কলেজে গোলমাল। পঞ্চায়েত থেকে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত যে কংগ্রেসকে রাজ্যে রাজনৈতিক সাফল্যের নিরিখে প্রায় ‘লোপাট’ করে দিয়েছিল তৃণমূল, গত ক’দিনের ‘ত্র্যহস্পর্শে’ সেই কংগ্রেসই আবার রাজ্য-রাজনীতিতে ‘প্রাসঙ্গিক’।
বস্তুত, এ রাজ্যের রাজনীতিতে কংগ্রেস ‘প্রাসঙ্গিক’ হয়ে ওঠায় খানিকটা ‘আশ্বস্ত’ হাইকম্যান্ড। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, সংসদে প্রথমে এফডিআই, তার পর লোকপাল বিল নিয়ে তৃণমূলের ভূমিকা এবং সবশেষে বেশ কিছু রাজ্যে বিধানসভা ভোট লড়তে গিয়ে সর্বভারতীয় স্তরে সরাসরি কংগ্রেসের সঙ্গে ‘পাল্লা’ দিচ্ছিল তৃণমূল। রাজ্যে আচমকা তিনটি ঘটনায় তাদের খানিকটা ‘ব্যাকফুটে’ ঠেলে দেওয়া গিয়েছে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে একই সঙ্গে তাঁদের আশা, এর ফলে জোটে কোনও প্রভাব শেষ পর্যন্ত পড়বে না। যা এ দিন প্রকাশ্যে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তাঁর কথায়, “সমস্যা ছাড়া জীবন হয় না। আমাদের সমস্যা রয়েছে।
মশাল-মিছিলে মৌসম। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়
কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী, আমাদের ইচ্ছে ও দৃঢ়তা থাকলে এই সাময়িক সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠবই।” কংগ্রেসের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারিও এ দিন বলেছেন, “আমাদের মতান্তর রয়েছে। তবে সেই মতান্তর আমরা আলোচনার মাধ্যমে কাটিয়ে উঠব।”
ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের কথায়, “আমাদের সাম্প্রতিক ভূমিকায় কংগ্রেস বিপন্ন বোধ করছে। বিশেষত, যে ভাবে আমাদের নেত্রী রাজ্যের স্বার্থে মুখর হয়েছেন, তাতে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব প্রমাদ গুনছে। সেই জন্যই সিপিএমের সুরে সুর মিলিয়ে এই সব আন্দোলন।”
রায়গঞ্জের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শুক্রবার গোটা রাজ্যে ‘সমালোচিত’ হয়েছে তৃণমূল। সিপিএম-সহ বিরোধী বামফ্রন্ট তো বটেই, এসইউসি-র মতো তৃণমূলের ‘প্রাক্তন’ জোটসঙ্গীর ছাত্র সংগঠন ডিএসও-ও ঘটনার কড়া নিন্দা করেছে। ওই ঘটনার পিছনে রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ দীপা দাশমুন্সির ‘মদত’ রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার অভিযোগ করেছিলেন মমতা-মন্ত্রিসভার একাধিক তৃণমূল সদস্য। তাঁদের মতে, ঘটনার আগের তিন দিন ধরে দীপার মদতে ছাত্র পরিষদের লোকজন তৃণমূলকে হেনস্থা করেছে। ঘটনার দিনও তৃণমূলের লোকজনকে আটকে রাখা হয়েছিল। তাদের ‘ছাড়াতে’ গিয়েই গোলমাল বাধে।
মমতা নিজে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না-করলেও ওই ঘটনা যে দীপার প্রতি তাঁর ‘বার্তা’, তা তৃণমূলের নেতারাই একান্ত আলোচনায় স্বীকার করছিলেন। যে ‘বার্তা’র জবাবে এ দিন রায়গঞ্জে দীপা আঙুল তুলেছেন ‘পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা’র দিকে। তিনি মমতার নাম করেননি। কিন্তু ‘দায়’ চাপিয়েছেন পুলিশ মন্ত্রীর উপর। প্রসঙ্গত, পুলিশ দফতরের দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতারই। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তিলক চৌধুরী শুক্রবার সারাটা দিন বহাল তবিয়তেই কাটিয়েছেন। এ দিন তাঁকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়নি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা পর্যবেক্ষক প্রিয়ব্রত দুবেকেও। উল্টে জেলার পুলিশ সুপার দীপঙ্কর ভট্টাচার্য দু’জনকে ‘আত্মসমর্পণের জন্য অনুরোধ’ জানিয়েছেন। যে অনুরোধের বিরুদ্ধে সমালোচনা উঠেছে গোটা পুলিশমহলে। খোদ উত্তরবঙ্গের আইজি সঞ্জয় সিংহও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ। পুলিশমহলের বড় অংশ মনে করছে, এর ফলে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগই প্রমাণিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় এ দিন যে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ‘লঘু’ ও জামিনযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করেছে। কিছু প্রবীণ পুলিশ অফিসারই বলেছেন, এই সব ধারায় মামলা হলে থানা থেকেই জামিন পাওয়ার কথা।
এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন দীপাদেবীও। তিনি বলেন, “সরকারি সম্পত্তি নষ্ট ও অধ্যক্ষকে মারধর করার মতো গুরুতর ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ জামিনযোগ্য ধারা দিয়ে জামিন পাইয়ে দিল। পুলিশের ভূমিকা ভাল নয়। পুলিশ রাজনৈতিক চাপে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। অভিযুক্তরা জামিন না-পেলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব হত।”
সাংবাদিক বৈঠকে দীপা।
তরুণ দেবনাথের ছবি।
দীপার পাশাপাশিই মমতা ‘বার্তা’ দিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ মৌসম বেনজির নূরকেও। বৃহস্পতিবারই প্রয়াত গনি খানের ভাগ্নী তথা মৌসম-বিরোধী শেহনওয়াজ কাদরিকে তৃণমূলে নিয়েছেন মমতা। যার ‘জবাবে’ এ দিন মৌসম মালদহে মশাল-মিছিল করে নদী-ভাঙনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। রাজ্যের সেচ দফতরটি অবশ্য কংগ্রেসের হাতে। কিন্তু নির্বিকার মৌসমের জবাব, “দফতর থাকলেও তো মুখ্যমন্ত্রী না-চাইলে কাজ করা যায় না! দফতর হাতে আছে বলেই তো বঞ্চনাটা আরও ভাল ভাবে বোঝা যাচ্ছে!”
পাশাপাশিই, বহু দিন পর রাজ্য জুড়ে রাস্তায় নেমে তাদের অস্তিত্ব ‘জাহির’ করেছে কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন ছাত্র পরিষদ। তাতে প্রবল দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সাধারণ মানুষের দিকে আর কবে রাজনৈতিক দলগুলি তাকিয়েছে! রাজ্য কংগ্রেসের এক শীর্ষনেতার কথায়, “অনেক দিন পর কংগ্রেস আবার জেগেছে। এটা মানুষ বুঝতে পারছেন।”
তৃণমূলের তরফে (যারা বহু দিন আগেই মিছিল-মিটিং-বন্ধ-অবরোধের রাজনীতি পরিত্যাগ করেছে) অবশ্য দাবি করা হয়েছে, এ ভাবে রাজনীতিতে ‘প্রাসঙ্গিক’ হওয়া যায় না। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “এর ফলে মানুষ বিরক্ত হন। গত কিছু দিন ধরেই বিভিন্ন জায়গায় কংগ্রেসের লোকেরা রেল এবং সড়ক অবরোধ করছে। মানুষ এ সব ভাল ভাবে নিচ্ছেন না। সেটা কংগ্রেসও বুঝতে পারবে।”
কংগ্রেসের নেতাদের অবশ্য দাবি, মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য প্রশাসন পরপর তিনটি বিষয় ঠিকমতো ‘সামলাতে’ না-পারাতেই যত গোলমাল হয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “আমরা কিন্তু কৃষক-স্বার্থে বহু দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিলাম। মেট্রো চ্যানেলে অবস্থান তারই সাম্প্রতিকতম ধাপ।” ক্ষমতায় আসার পর কংগ্রেস-তৃণমূলের সামনে প্রথম বড় নির্বাচন হল পঞ্চায়েত ভোট। মুখ্যমন্ত্রী সেই ভোট এগিয়ে আনলেও (মমতা ২০১৩-র মে মাসের বদলে চলতি বছরের ডিসেম্বরে ওই ভোট করার পক্ষপাতী) হাতে সময় কার্যত একটা বছর। ফলে কংগ্রেস ‘অঙ্ক কষে’ই কৃষক-স্বার্থে সরব হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন মমতাও। তাই এ দিনই তিনি ধান-পাটের সহায়ক-মূল্য বৃদ্ধি এবং সারের ভর্তুকির বিষয়ে চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে। যে চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এর আগেও তিনি ওই বিষয়ে কেন্দ্রীয় রসায়ন ও সার দফতরের প্রতিমন্ত্রী শ্রীকান্ত জেনাকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। আলোচনা করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।
সাম্প্রতিক ‘সাফল্যে’ উজ্জীবিত কংগ্রেস এ দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চাষিদের কাছ থেকে দ্রুত খাজনা আদায়ের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আগামী মাস থেকে জেলায় জেলায় গিয়ে চাষিদের ‘একজোট’ করে বিক্ষোভ দেখানো হবে। গোটা পরিস্থিতি এ দিন প্রণববাবুকে জানান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। প্রদেশ নেতৃত্বের এক বৈঠকের পর তিনি বলেন, “চাষিরা ধান বিক্রি করতে পারছে না। তার উপর জোর করে চাষিদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের এই জুলুম দুর্ভাগ্যজনক।”
বস্তুত, কংগ্রেসের একাংশে দাবি উঠেছে, তৃণমূলের মন্ত্রীরা যেমন তাদের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন, কংগ্রেসের মন্ত্রীরাও তার পাল্টা দিন। কিন্তু প্রদেশ নেতৃত্ব তাতে এখনও ‘অনুমোদন’ দেননি। বরং রাজ্য মন্ত্রিসভার কংগ্রেসি সদস্য মানস ভুঁইয়া এ দিন জেলাসফরে গিয়ে জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কোনও প্রভাব জোটের উপর পড়বে না। তাঁর কথায়, “কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট আছে। থাকবে।”
ঘটনাচক্রে, যে তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে শাসক শিবিরে ‘কোণঠাসা’ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে কংগ্রেস, তার প্রতিটিতেই তাদের সুর মিলছে বিরোধী বাম-শিবিরের সঙ্গে। এ দিনই বামফ্রন্টের বৈঠকে কৃষক-সঙ্কট নিয়ে আলোচনার পর ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “কৃষকরা ধান-পাট-আলুর ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যেই ১২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এই পরিস্থিতি বন্ধে অবিলম্বে রাজ্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে সহায়ক-মূল্যে কৃষকদের থেকে ধান কিনতে হবে।”
ইন্দিরা ভবনের নামবদল নিয়ে রাজ্য সরকার ‘অযথা বিতর্কে’ জড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছে শাসক শিবিরেই একাংশ। যে ঘটনায় খানিকটা হলেও ‘ফায়দা’ তুলতে পেরেছে কংগ্রেস। প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধীর নামের সঙ্গে আবেগ জড়িত থাকায় বিষয়টি ‘অন্য মাত্রা’ পেয়ে গিয়েছে। এ দিনই যেমন উত্তর কলকাতা জেলা যুব কংগ্রেসের এক প্রতিনিধিদল রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের সঙ্গে দেখা করে ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। নজরুলকে নিয়ে ‘অনভিপ্রেত বিতর্ক’ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে বামফ্রন্টও। বিমানবাবুর কথায়, “ইন্দিরা ভবনে নজরুল অ্যাকাডেমি এক অদ্ভুত ব্যাপার! পরিস্থিতির বাস্তবসম্মত বিচার করা উচিত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.