|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
শব্দে জব্দ |
১৬ বছরের পুরনো নাটক। আবার মঞ্চে। কিন্তু ‘অশালীন’ ভাষার
সংজ্ঞাটাই যে এখন পাল্টে গেছে। লিখছেন সুদীপ ঘোষ |
‘দিল্লি বেলি’ আর ‘২২শে শ্রাবণ’-এর পর ‘ব’ আর ‘গ’ দিয়ে শুরু শব্দব্রহ্ম, পরিভাষায় যাকে ‘খিস্তি’ বলে, প্রেক্ষাগৃহে শোনা এখন জলভাত। অন্তত বাঙালি দর্শকদের। তাই পূর্ব-পশ্চিম-এর নতুন প্রযোজনা ‘অশালীন’ দেখতে বসে তাঁদের ১৬ বছর আগের মতো চোখ কপালে উঠে যাবার কথা নয়। যায়-ও নি।
১৯৯৬-এ গণকৃষ্টি-র প্রযোজনায় ব্রাত্য বসুর লেখা এবং পরিচালনায় ‘অশালীন’-এর প্রথম শো-য়ে ‘শক্ড’ হয়েছিল কলকাতা। ২০১১-য় পূর্ব-পশ্চিম-এর ‘অশালীন’-এর প্রথম শো’য়ে প্রতিক্রিয়াটা ছিল উপভোগের। বিষেশত সেই সব সময়ে যখন সুজনরূপী রাহুল টালিগঞ্জের মেনস্ট্রিম সিনেমার আবর্ত থেকে যিনি ২০১১-য় আবার ফিরলেন মঞ্চে হুটহাট তথাকথিত ‘অশ্লীল’ শব্দ উচ্চারণের চেষ্টা করছেন আর তারানাথ-রূপী বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এক দিকে বাৎসল্য আর অন্য দিকে পারিবারিক ভদ্রতার টানাপোড়েনে নাস্তানাবুদ হয়ে তাঁকে আটকাতে মঞ্চ কাঁপিয়ে লাফঝাঁপ করছেন।
কিন্তু এত দিন পর আবারও সেই একই নাটককে মঞ্চে আনার কারণ কী? দর্শকদের মধ্যে চার অক্ষর ছড়ানো সংলাপের যে আধুনিক জনপ্রিয়তা, সেটা মঞ্চেও সফল হয় কি না, তা দেখতেই? পূর্ব-পশ্চিমের কর্ণধার সৌমিত্র মিত্র বলছেন অন্য কথা: “আসলে ‘অশালীন’ নাটকটি যুগপৎ সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। ষোলো বছর আগে চমকে গিয়েছিলাম এর ভাষায়, শব্দবন্ধে, আঙ্গিকে।”
তা হলে প্রশ্ন: পুরনো সেই ঝাঁজের চাবুক রইল কি? ‘অশালীন’-এ হয়তো ‘উইঙ্কল-টুইঙ্কল’ বা ‘রূদ্ধসঙ্গীত’-এর রাজনৈতিক উচ্চারণ নেই। নাটককারের নিজের স্বীকারোক্তিতেই “ট্র্যাডিশনালি দেখতে গেলে অনেক কাঁচা ব্যাপারও আছে”। কিন্তু তিনটি নাটকেরই একটা জায়গায় মিল। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়। ব্রাত্যর পরের দু’টো নাটকে সেই প্রতিষ্ঠান বাম অচলায়তন। প্রথম নাটকে সেটা সমাজ। নব্বইয়ের মাঝামাঝি ‘সমাজ’কে এমন বেজোড় খিস্তির সামনে দাঁড় করানোটাই বঙ্গমঞ্চে হইচই ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই? “প্রথম কারণ অবশ্যই ছিল থিমের অভিনবত্ব,” বলছেন ব্রাত্য। “আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ আর একটা আকর্ষণ ছিল। আর যে ফর্ম্যাটে তখন থিয়েটারটা হত, তার থেকে একেবারেই আলাদা ছিল ‘অশালীন’।”
নাটকে ‘খিস্তি’র ব্যবহার (যেটাকে ব্রাত্য বলছেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ’) সে সময়ে চমক ছিল। কিন্তু আসলে তো এ নাটক কাটতে চায় সেই ঊর্ণা, যার ঊষ্ণ পরিবেশে ‘ভদ্র জনেরা’ পরিশীলনের পর্দা টাঙিয়ে বেমালুম নিশ্চিন্তে বসে আছেন এবং সারাক্ষণ নিজেদের অন্ধকারগুলোকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছেন। একেবারে সেই ‘নকশা’-খ্যাত হুতোমের মতোইকেবল এ নাটকে সে মুচকি হাসছে না আর, ভীষণই রেগে গেছে আসলে।
এত সমসাময়িক একজন নাটককারের প্রথম লেখা মৌলিক নাটক আবারও মঞ্চে ফিরিয়ে আনার মধ্যে সাহস তো আছেই, একটা বিশ্বাসের জায়গাও আছে নিঃসন্দেহে। সৌমিত্র মিত্র বলছিলেন, “নাটকে কিচ্ছু পাল্টাইনি। ১৬ বছর আগে যে প্রেক্ষিত ছিল (সে কারণেই এ নাটকে কেউ মোবাইল ফোনে কথা বলেন না, ল্যান্ডলাইনে এসটিডি করেন), যে সংলাপ ছিল, সব রেখেছি। পাল্টেছি মঞ্চ, আবহ, আলো।”
১৬ বছর আগের মঞ্চ ছিল বাহুল্যবর্জিত সামনে একটা ভিকট্রি স্ট্যান্ড, যেটা বসার জায়গা হিসেবে ব্যবহার হত। একটা দোলনা। আর পেছনে ঝুলছে কয়েকটি অক্ষর। দোলনা এখনও আছে। কিন্তু আজকের ‘অশালীন’-এর মঞ্চ অনেক সাজানোবাগান, ফুল, এমনকী খাঁচায় কয়েকটি জীবন্ত পাখি পর্যন্ত। ভিকট্রি স্ট্যান্ডের জায়গায় চেয়ার-টেবিল। এখানে অক্ষররা আসে হেঁটে হেঁটে নাটকের ঘাত-প্রতিঘাত যখন পৌঁছয় তুঙ্গে।
আর সেখানেই প্রশ্ন। মঞ্চে আলো যখন ফোটে, তখন একটা সুখী বাতাবরণের আবহ তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু ১৬ বছর আগের বাহুল্যহীন মঞ্চসজ্জায় যে ঝাঁজ ছিল, তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। অথচ নাটকের হৃদয় ভরা ভীষণ ঝাঁজে।
ব্রাত্য একমত? “আমি এ নিয়ে কোনও মন্তব্যই করব না,” বলছেন নাটককার।
ঝাঁজের অনেকটাকেই তাই ভর করতে হয়েছে অভিনেতাদের কাঁধে। রাহুল, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত। সৌমিত্র মিত্র, পৌলমী বসু, অবন্তী দত্ত। এঁরা প্রত্যেকে নিজেদের কাজটা ফাটিয়ে করেছেন। কিন্তু এবারের পরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় আটকেছেন অন্য জায়গায়। ঠিক যেমন নাটকের এক অংশে রাহুল বলেন, “আমি আপনাকে আমার বাক্য দিয়ে, শব্দ দিয়ে সমানে ছুঁতে চাইছি, কিন্তু আপনার পুরোটাকে কি আমি ছুঁতে পারছি?,” ঠিক তেমনই দর্শকদের আরও নাড়াতে ১৬ বছরের পুরনো শব্দগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়ার দরকার ছিল। হয়তো কোনও কোনও জায়গায় কাটছাঁটেরও। যখন ‘গ’ দিয়ে দু-অক্ষরের শব্দ অবলীলায় সিনেমার নাম হচ্ছে, তখন তার থেকে অনেক নিরীহ ‘খিস্তি’র উচ্চারণে বাধা দেওয়ার কারণ থাকতে পারে কি? আর সেখানেই বা আটকে থাকা কেন? বিরতি পরবর্তী অংশের অন্ধকার গাম্ভীর্য যাতে সর্বগ্রাসী না হয়ে যায়, তার জন্য আগের অংশে অনেকটাই ফাজিল-রস ঢালা হয়েছিল আসল নাটকে। ফেসবুক-বিবিএম-মোবাইলহীন সেই সময়ে এমন সাজুয্যের দরকার ছিল হয়তো। কিন্তু এখন সময়টা তো অনেক ধারালো। যে সময়ে ১৪০টা অক্ষরে মতামত গঠন হয়ে যাচ্ছে, সে সময়ে আগের নাটকের এই প্রাতিষ্ঠানিক গঠনটাকে একটু উল্টেপাল্টে নিলে হত না?
“সেটা ইচ্ছে করেই করিনি,” বলছেন পরিচালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়। “তা হলে তো নতুন করে একটা নাটক লিখলেই হত। প্রেক্ষিতটা বোঝাতে শুরুতে তাই নাটককারের বক্তব্যের অডিও-ভিস্যুয়ালটা ব্যবহার করেছি। যাতে নাটকের জার্নিটা বোঝানো যায়।”
অবশ্য সব জার্নিরই একটা মৌলিক বার্তা থাকে। ট্যুইটারি-বক্তব্যের যুগে জীবনের যান্ত্রিকতা হয়তো অনেক জটিল হয়েছে, অন্তর্মুখিনতা অনেক বেড়েছে, কিন্তু একটা জীবন একসঙ্গে কাটিয়েও বরাবর অচেনা থেকে যাওয়ার যে ট্রাজেডি, সেটা একই আছে। বরং আরও বেদনাময় হয়েছে। ‘অশালীন’-এর সেই হৃদয়টাকে একই জায়গায় রেখেছেন রাহুল, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্র, পৌলমীরা। পরিচালক হিসেবে বিপ্লবও সেই জায়গাটা তৈরি করে দিয়েছেন তাঁদের। ১৬ বছরে জমা খানিকটা ধুলো সত্ত্বেও শো-এর শেষে দর্শক-বাহবা পাচ্ছে আসলে এই অভিনয়টাই।
শুরুর অডিও-ভিস্যুয়ালে ব্রাত্য বলেছিলেন, “থিয়েটার একটা অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়... দেখা যাক সেটা হয় কি না?” নতুন ‘অশালীন’ কি ব্রাত্যর সে আশা পূরণ করল?
“নাটকটায় প্লট-এর বাঁধুনির ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল। চরিত্র গঠনেও ছিল। সেগুলো এখনও আছে। তবে থিমটা এখনও টানে। এবং সেটাই ওই বিরাট অনিশ্চয়তার দিকে এখন কিন্তু তিনি পরিচালক হলেও কি এ ভাবেই করতেন ‘অশালীন’? “না। আমি পরিচালক হলে এই নাটকটাই করতাম না,” ব্রাত্যর পরিষ্কার উত্তর। “আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমার আগের সব লেখাই কাঁচা লাগে। আসলে আমার লিখিত শেষ নাটক ছাড়া আর কোনও নাটককেই আমি পসেজ করি না।” |
|
|
|
|
|