অচলাবস্থা কাটেনি। তিন মাস ধরে বন্ধ বেতন। অর্থাভাবে পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে দিন কাটছে শ্রমিকদের। বাধ্য হয়ে এ বার পথে নেমে আন্দোলন শুরু করলেন কল্যাণী স্পিনিং মিলের উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর ইউনিটের শ্রমিকেরা। দ্রুত মিল খোলা এবং বকেয়া বেতনের দবিতে শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে ২টো পর্যন্ত থালা-বাটি-গ্লাস নিয়ে মিলের কয়েকশো শ্রমিক যশোহর রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। অবরোধ, বিক্ষোভে সামিল হয়েছিলেন শ্রমিকদের পরিবারের মহিলা এবং শিশুরাও। সকালে ব্যস্ত সময়ে আচমকা এই অবরোধে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আটকে পড়েন অফিসমুখো বহু মানুষ। যশোহর রোডের দু’দিকেই গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়। পরে অশোকনগর থানার পুলিশ এবং লেবার কমিশনার ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা পরে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।
থালা, বাটি, গ্রাস নিয়ে কেন তাঁরা অবরোধ-বিক্ষোভে নেমেছিলেন জানতে চাওয়া হলে, মিল-শ্রমিক সুজয় সরকার, ভোলানাথ দত্ত বলেন, “তিন-চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। এই মাগ্গিগণ্ডার বাজারে কী ভাবে সংসার চালাব বলতে পারেন? ছেলেমেয়ের টিউশনের মাইনে দিতে পারি না। দোকানে ধারে আর কতদিন মাল দেবে। বাধ্য হয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছি।” |
গত বছর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, বকেয়া টাকা না দেওয়ার জন্য মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেয় বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানি। সেই থেকে কারখানা সংলগ্ন কর্মী আবাসন এবং শ্রমিক আবাসনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায় ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে কল্যাণী স্পিনিং মিলের অশোকনগর ইউনিটের ভবিষ্যৎ। মিল খোলার দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরেই নিয়মিত ভাবে মিলের গেটের সামনে অবস্থান-বিক্ষোভ করছেন কর্মীরা। এর আগে একবার কল্যাণীতে রাস্তা অবরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু পরিবার-পরিজন, থালা-বাটি নিয়ে এমন বিক্ষোভ এই প্রথম বলে জানালেন শ্রমিকেরা। তাঁরা জানান, স্থানীয় বিধায়ক ধীমান রায়-সহ সংশ্লিষ্ট সব মহলেই তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি। পরিবর্তে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের।
রাজ্য সরকার পরিচালিত এই মিলটি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের অধীন। দফতরের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াকেও মিলের অচলাবস্থার কথা জানিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানান ধীমানবাবু। এমনকী গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি এই বিষয়ে দেখাও করেন। ধীমানবাবু জানান, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর সঙ্গে কথা বলেন। ধীমানবাবু বলেন, “অর্থমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, মিলটির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুবোধকান্ত সহায়-এর সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন।”
ধীমানবাবুর দাবি, বাম সরকারের আমলে মিলের ২৬ কোটি টাকা দেনা হয়েছে। অথচ উৎপাদন বলতে কিছু ছিল না। মিলের শ্রমিকদের বেতন বাবদ মাসে রাজ্য সরকারকে দিতে হয় ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। বাম সরকার শ্রমিকদের ইএসআই, পিএফ ফান্ডে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে শ্রমিক-কর্মচারিরা অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের প্রসঙ্গে ধীমানবাবু বলেন, “অর্থমন্ত্রী এক মাসের বেতনের অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি মিলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুব্রত সরকার অবসর নিয়েছেন। নতুন এমডি এখনও কার্যভার গ্রহণ করেননি। ফলে শ্রমিকদের বেতন আটকে রয়েছে। নতুন এমডি কাজে যোগ দিলেই শ্রমিকেরা বকেয়া বেতন পেয়ে যাবেন।”
ধীমানবাবুর দাবির প্রসঙ্গে অশোকনগরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক সত্যসেবী কর বলেন, “২৬ কোটি টাকা দেনা আছে কি না আমার জানা নেই। তবে রাজ্য সরকার মিলটি তুলে দিতে চাইছে। যদিও মিলের অবস্থা তুলে দেওয়ার মতো নয়। এর পুনরুজ্জীবন সম্ভব। মিলটি লাভজনক না হলেও বাম সরকার ভর্তুকি দিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থে মিলটি চালু রেখেছিল। অথচ বর্তমান সরকার মিলটি বন্ধ করে দিতে চাইছে।” মিল সূত্রে জানা গিয়েছে, কল্যাণী, অশোকনগর মিলিয়ে মিলে বর্তমান শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১শো। মাস তিনেক আগে যখন দু’টি ইউনিটের বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয় তখন বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬০ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা। মিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বর্তমানে মিলের যাবতীয় সমস্যা সম্বন্ধে রাজ্য সরকার ওয়াকিবহাল। এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাজ্য সরকারই নেবে। |