উত্তর কলকাতা
নিমতলা
আতঙ্কের বসবাস
রাস্তার দু’ধারে সারি সারি কাঠের বাড়ি। কোনও কোনও বাড়ির পুরোটাই কাঠের গোলা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কোথাও কোথাও বাড়ির দোতলায় কাঠের মেঝের ওপরেই উনুন জ্বেলে চলছে রান্নাবান্না। দু’টি কাঠের গোলার মাঝখানে রয়েছে শুধু একটি কাঠের পাটাতন। কাঠগোলা ছাড়াও কোনও কোনও কাঠের গুদামে ডাঁই করা রয়েছে কাপড়ের বস্তা। কোথাও কোথাও চলছে ফ্লেক্স তৈরির কাজও। কিন্তু, বেশির ভাগ কাঠগোলা বা কাপড়ের গুদামে কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাই নেই।
এই ভাবেই উত্তর কলকাতার নিমতলাঘাট স্ট্রিট সংলগ্ন স্ট্র্যান্ড রোড এবং মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডে রমরমিয়ে চলছে কাঠগোলা। এলাকার মানুষের আশঙ্কা, আগুন লাগলে নিমেষে তা ছড়িয়ে পড়বে গোটা এলাকায়। এখানে আগুন লাগার ঘটনাও নতুন নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশাসনের ঘুম ভাঙেনি বলে তাঁদের অভিযোগ। সমগ্র এলাকাই কার্যত জতুগৃহে পরিণত হয়েছে। এমনকী, এখানে দমকল ও পুরসভার নজরদারি নেই বলেও বাসিন্দাদের অভিযোগ।
দমকলের নজরদারি ছাড়া কী ভাবে এখানে এ রকম দাহ্যবস্তুর ব্যবসা চলছে? ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেওয়া বা নবীকরণের ক্ষেত্রেও কি কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই? রাজ্যের দমকলমন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খান বলেন, “দমকল দফতরে যে পরিমাণ লোকের দরকার তা নেই। ফলে, নজরদারির অভাব রয়েছে।ব্যবসায়ীদের একাংশের ফায়ার লাইসেন্সও নবীকরণ করা হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব এই এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যে কোনও ধরনের দাহ্য পদার্থের ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স নিতে গেলে দমকলের ছাড়পত্র আবশ্যিক। দমকলের ছাড়পত্র না থাকলে পুরসভা কাউকে ট্রেড লাইসেন্স দেয় না। ইদানিং লাইসেন্স নবীকরণের ক্ষেত্রেও পুরসভা দমকলের ছাড়পত্রের ওপর গুরুত্ব দেয়। শহরের অনেক জায়গাতেই লাইসেন্সবিহীন ব্যবসাদারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বদা পরিদর্শনের জন্য যে ধরনের পরিকাঠামোর প্রয়োজন তা পুরসভার নেই।”
দমকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নিমতলার কাঠগোলার মতো জায়গায় আগুন নির্বাপণের জন্য প্রয়োজন জলের ব্যবস্থা রাখা। এ ছাড়াও, কাঠগোলার দেওয়াল কাঠের পরিবর্তে ইট দিয়ে নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র মজুত রাখা এবং পুরনো বৈদ্যুতিক তারের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। যদিও বেশির ভাগ কাঠগোলাতেই তার ব্যবস্থা নেই। এই অঞ্চলের কাঠগোলার এক মালিক সুব্রত দাস বলেন, “এই সমস্ত কাঠগোলা সরকারের ঠিকা জমিতে গড়ে উঠেছে। আইন মোতাবেক এখানে কোনও ভাবেই পাকা বাড়ি বা স্থায়ী নির্মাণ করা যাবে না। ফলে, কাঠের নির্মাণ করতেই হয়। সেটাই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। অন্য দিকে, এলাকায় আগে গঙ্গাজলের জন্য যে সমস্ত হাইড্রান্ট ছিল সেগুলিও কাজ করছে না। আমার কাঠগোলায় আগুন নেভানোর জন্য কিছু ব্যবস্থা আছে। এর বাইরে আর কিছু প্রয়োজন কি না সেই ব্যাপারে দমকল পরিদর্শন করে কিছু জানায়নি।”
এলাকার আর এক ব্যবসায়ী সমীর বিশ্বাসের কথায়: “অনেক আগে দমকল যখন কাঠগোলা রাখার জন্য পরিদর্শন করেছিল তখন জলের ব্যবস্থা রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল। পরে আমি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও রেখেছি। আমার কাঠগোলায় ২৪ ঘণ্টা গঙ্গাজল আসার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। কিন্তু কাঠের বাড়ি সবচেয়ে বড় সমস্যা। এখানে অল্প আগুন লাগলেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।”
১৯৪৯ সালের মে মাসে নিমতলার এই কাঠগোলা অঞ্চলে আগুন লাগে। দীর্ঘ সাত দিন ধরে এখানে আগুন জ্বলেছিল। এর পরেও এখানে বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় আগুন লেগেছে। কিন্তু তার পরেও অবস্থার কোনও হেরফের হয়নি। দমকল কর্তৃপক্ষ জানান, শহরের অনেক জায়গাতেই হাইড্রান্ট বন্ধ। কিছু কিছু জায়গায় তা চালু রয়েছে। বর্তমানে দমকল পুরসভার বিভিন্ন পাম্পিং স্টেশন থেকে জল নেয়। নিমতলা স্ট্রিটে কাঠগোলার ক্ষেত্রে জলের খুব একটা সমস্যা নেই। পাশেই গঙ্গা থাকায় জল পাওয়া যায়। তবে, কাঠগোলাগুলিতেও নিজস্ব জলের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আপাতত, এখানে কাঠগোলার জন্য একটি ছোট দমকলও সব সময়ের জন্য মজুত রাখা হয়েছে।
নিমতলা টিম্বার মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অমল সরকার বলেন, “কাঠগোলা অঞ্চল এখনও জতুগৃহ। বার বার বলা সত্ত্বেও দমকল এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখানে প্রথম দরকার কাঠের নির্মাণের পরিবর্তন। ইট-কাঠের স্থায়ী নির্মাণ করলে আগুন লাগার আতঙ্ক কমবে। অভাব রয়েছে দমকল এবং প্রশাসনের নজরদারিরও। এই সুযোগে অনেক ব্যবসায়ী কাঠগোলা ছাড়াও কাঠের গুদাম পণ্য পরিবহণের গুদাম হিসেবেও ব্যবহার করছেন। সেখানে কাপড় ছাড়াও নানা রকম দাহ্য পদার্থ মজুত থাকছে।” স্থানীয় কাউন্সিলর অজয় দাস বলেন, “দমকল, পুরসভা এবং বন্দর নিয়ে এই সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক বারই বলা হয়েছে। কিন্তু কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি।”
দমকল কী কী ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
জাভেদ আহমেদ খান বলেন, “আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হল ফায়ার অডিট টিম করে শহরের বিভিন্ন জায়গা পর্যবেক্ষণ করে তার রিপোর্ট তৈরি করা। দমকলের আইন ভেঙে কোনও ব্যবসা চললে তা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করা এবং এই সংক্রান্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দমকল আইনে ফায়ার অডিট টিমের উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়িত করা হয়নি। সেই কাজ শুরু করা হচ্ছে। এ ছাড়াও এই মুহূর্তে দমকল দফতরে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক নেই। সেই শূন্যস্থানগুলি পুরণ না করলে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দমকল দ্রুত এই ব্যবস্থাও গ্রহণ করছে।”

ছবি: গৌতম বসুমল্লিক




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.