ভারত নিরঙ্কুশ হারল, সচিন এখনও অপরাজিত
ন্য বার জন্মদিনে তাঁর ফোন মেয়ের কাছে গচ্ছিত থাকে। এই বিশেষ দিনে সে-ই ফোন-টোন ধরে। এ বার কপিল দেব নিজে ধরলেন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা নেওয়ার আগে তাঁর একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ম্লান কন্ঠস্বর, “তিনশো হয়েছিল?”
বললাম, তিনশো কী। চারশো হয়েছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন ৬২। সিরিজে যাঁর রান এখন ধোনি-কোহলি-লক্ষ্মণ-সহবাগ-দ্রাবিড়ের চেয়ে বেশি। “অ! কী অবস্থা,” কিছু পরেই কপিল ফোন ছেড়ে দিলেন। জন্মদিনের ভোরে সিডনি থেকে উড়ে আসা হতাশার হ্যাংওভার যে কাটাতে পারেননি বোঝাই যাচ্ছে। এও মনে হল, কোটি কোটি ভারত সমর্থকের মতোই বোধহয় লাঞ্চের পর তেন্ডুলকর আউট হয়ে যেতে টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই তিনশোও হয়েছে কি না জানেন না।
বারো বছর পর অস্ট্রেলিয়ার কাছে ইনিংসে হারল ভারত। এ বারেরটা ইনিংস ও ৬৮ রানের চেয়েও কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য, সে বার ভারতীয় কোচের নাম ছিল কপিল দেব!
সত্যের খাতিরে এটাও অবশ্যই যোগ করা উচিত, সেই অস্ট্রেলিয়া আর এই অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে তুলনাই হয় না। এরা দু’মাস আগে ফর্টি সেভেন অলআউট হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে নিজের দেশে নিউজিল্যান্ডের মতো বগা টিমকে সামলাতে পারেনি। ২-০ সিরিজে এগিয়েও এদের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের চাপের মুখে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যে পরিস্থিতি, তার কোনও উন্নতি হয়নি। অথচ তারাই কিনা মাত্র আট দিনের টেস্ট ক্রিকেটে এতগুলো লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে টিম ইন্ডিয়া-কে দাঁড় করিয়ে দিল।
আপার কাট। যা এই সফরে সচিনের ব্যাটে শিল্পের পর্যায়ে। ছবি: এপি
বিদেশে টানা ছ’টা টেস্ট ম্যাচ হারল ধোনির ভারত। রাজন্যভাতা বিলোপ হওয়া পরবর্তী পৃথিবীতে ভারতীয় ক্রিকেট যে জিনিস দেখেনি!
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সিরিজ জেতার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। ভারত এখন বড়জোর বাকি দুই টেস্ট জিতে অমীমাংসিত রাখতে পারে। আর সেই জেতাটাও ফিল্ম বানিয়ে ইউ-টিউবে দেখানো যত সহজে সম্ভব, বাইশ গজে সত্যি সত্যি করাটা ততই অবাস্তব।
তথাকথিত বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন-আপ এমন বিধ্বস্ত হয়ে গেল যে, সিডনির মতো ব্যাটিং উইকেটে খেলে উঠেও তাদের জন্য সুপারিশ হচ্ছে মনোবিদ দেখানোর। ইয়ান চ্যাপেলরা বলতে শুরু করেছেন, ব্যাটসম্যানদের সমস্যাটা টেকনিক্যাল নয়। মানসিক। আগামী ক’দিনে কোরাস তৈরি হয়ে প্রচারটা ঊর্ধ্বগামী হতে বাধ্য।
অবশ্য যখন রোম পুড়ছিল তখনই না সম্রাট নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন! আজ ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম লজ্জাজনক দিনেই কিনা বিসিসিআই প্রকাশ করে দিল আইপিএলের সূচি! ট্রান্সফার উইন্ডো নিয়ে মিডিয়াকে মেল পাঠাল। যা দেখে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিকেরা বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছেন। এমনিতে অস্ট্রেলিয়া শিবিরে শঙ্কাচ্ছন্ন মনোভাব জারি থাকা উচিত। সিরিজে সবচেয়ে ত্রাস সৃষ্টিকারী জেমস প্যাটিনসন-ই পায়ের চোটের জন্য বাকি সিরিজ থেকে বাদ হয়ে গেলেন। ভারতীয় দলে তেন্ডুলকর বসে যাওয়ার মতো ব্যাপার। কিন্তু তাতেও উৎফুল্ল হওয়ার সুযোগ নেই, যেহেতু খবর পৌঁছেছে পার্থ উইকেটের ‘শেফ’ ভারতের জন্য পুরু ঘাসের ব্যবস্থা রেখেছেন। প্যাটিনসন না থাকলে কী, দেশে যে চার জন ফিট পেসার আছে তাদেরই লেলিয়ে দেবে অস্ট্রেলিয়া। মাইকেল ক্লার্ক বলেই দিলেন, “আমি সিরিজটা পার্থেই শেষ করে দিতে চাই।”
৩-০ হচ্ছেই যাঁদের মনে হচ্ছে সেই তালিকায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও পড়েন। শুক্রবার টেস্ট শেষে তাঁকে দেখে মনে হল, চার বছরের একটা চাপা গ্লানি বিচার পাচ্ছে বলে কোথাও যেন উত্তেজিতও। বিদেশে ধোনির চেয়ে তাঁর অধিনায়কত্ব অনেক উঁচু দরের এই বিশ্বাস এ বারের সফর থেকে আরও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে নয়। সযত্ন লুক্কায়িত উল্লাস কাজ করছে। তোরা আমায় জোর করে সরিয়েছিলি তো! আজ দ্যাখ ক্ষতি করতে গিয়ে উপকারই করলি। বিদেশে এমন ভয়াবহ রেকর্ডের সঙ্গে ক্যাপ্টেন বা প্লেয়ার হিসেবে অন্তত আমার নাম জড়িয়ে থাকল না!
টেস্ট শেষের সাংবাদিক সম্মেলন কভার করতে গিয়ে বারবারই সৌরভ-কুম্বলের কথা মনে হচ্ছিল। সিডনি ভারতের এত প্রিয় সারফেস। এখানকার ব্র্যাডম্যান চেঞ্জিংরুমে হওয়া প্রেস কনফারেন্সে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই রক্ষণাত্মক মেজাজে থাকে। সে অধিনায়ক স্টিভ হন বা পন্টিং। আর ভারত অধিনায়কেরা হয় জিততে জিততে কোনও রকমে ড্র করেন বা তেন্ডুলকরের সেঞ্চুরি সমেত নৈতিক যুদ্ধজয়ীর পতাকা হাতে রাখেন। এর পিছনে ঐতিহাসিক ভাবে একটা প্যাটার্নও কাজ করে এসেছে। নিচু বাউন্সের সিডনি উইকেট।
যাকে কাজে লাগিয়ে ভিভিএস লক্ষ্মণ চতুর্থ দিন দুপুরে সিরিজে প্রথম হাফসেঞ্চুরিটা করে ফেললেন। কিন্তু পায়ের মুভমেন্ট এত মন্থর হয়ে গিয়েছে যে, বাকি সিরিজে পঞ্চাশ হওয়ার পক্ষে বাজি ধরছি না। দ্বিতীয় নতুন বল আসামাত্র তিনি আউট হয়ে গেলেন। গম্ভীর সর্বোচ্চ স্কোরার। কিন্তু অফস্টাম্পের বাইরে বাউন্সি বলে যেমন ব্যাট পেতে দিচ্ছেন, তিনিও ভরসা কিছুতেই হতে পারেন না। অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট ম্যাচে কোহলিকে নিয়ে শব্দ খরচ করার মানে হয় না। দ্রাবিড় ফর্ম হাতড়াচ্ছেন। সহবাগের ব্যাটিং বিজ্ঞান মেনে পতন অব্যাহত থাকছে।
বাকি থাকেন সেই সচিন। আর শুধুই সচিন।
সকালে তিনি যখন ব্যাট করতে নেমেছেন, মাঠে লোক নেই বললেই হয়। এমনকী প্রেসবক্সে পর্যন্ত অনেক সিট ফাঁকা। অবাক লাগছিল। মাত্র ক’দিন আগে সিডনিতে তেন্ডুলকর নিয়ে এত হাইপ হল, আর এর মধ্যেই কিনা লোকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। এ তো প্রকাশ্য অনাস্থা। না কি অনাস্থাটাই ভাল? তেন্ডুলকরের ওপর থেকে শততম সেঞ্চুরির চাপটা আজ অনেক কম থাকবে। তাঁর সুবিধে হবে!
মনে হল সুবিধে হবে। কারণ, শুরু থেকেই আক্রমণে এলেন। অফ-ড্রাইভ করছেন। কাট করছেন। এত আক্রমণাত্মক যে, ডিন জোন্সের মনে হচ্ছিল তিনি টিভি বক্স নয়, মাঠে আছেন। আর সালটা ১৯৯২। উনিশ বছরের ছেলেটা বর্ডারের টিমের বিরুদ্ধে ব্যাট করছে। ব্র্যাডম্যান স্ট্যান্ডে বসা মেম্বাররা তখন ক্রমশ গা গরম করতে শুরু করেছেন। মাঠে ভিড় বেড়ে সতেরো হাজারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এই সময় তেন্ডুলকর ফের স্লিপের মাথার ওপর দিয়ে নিখুঁত আপার-কাট শুরু করে দিলেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রবীণ ক্রিকেটাররা তখন নিজেদের মধ্যে মেম্বার্স স্ট্যান্ডে আলোচনা করছেন: টেস্ট ক্রিকেটে এই শটটা ওর একেবারে নিজস্ব। আমাদের দেশে আর কাউকে নিঃসন্দেহে কখনও খেলতে দেখিনি।
অস্ট্রেলিয়ান রেডিওর ভাষ্যকারেরা একই সময় বলাবলি করছেন, এত হাই রিস্ক শট ঘনঘন তেন্ডুলকর নিচ্ছে। যতই বাউন্ডারি পাক। ক্লার্ক খুশিই হবে। তাঁদের কথা শুনতে শুনতে টনি শিলিংল-র গবেষণার কথা মনে পড়ে গেল। শিলিংল প্রাক্তন ইংরেজ ক্রিকেটার এবং কোচ। তিনি ব্র্যাডম্যানের টেকনিকের ওপর বায়োমেকানিক্যাল গবেষণা করেছেন। পাঁচ বছর ধরে। লিভারপুলের জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ছিলেন তাঁর সহযোগী। এঁদের রায়: তেন্ডুলকর আর ব্র্যাডম্যানের স্ট্রোক খেলার মিল আছে এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। স্বয়ং ব্র্যাডম্যান তাই মনে করতেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট গবেষণা দেখাচ্ছে মোটেও নয়। তেন্ডুলকর হলেন টেক্সটবুক। সনাতনী। আর ডন একটা বৃত্তাকার, ব্যাকরণ বহির্ভূত পদ্ধতি ব্যবহার করতেন বল হিট করার জন্য। ডন ব্যাট করতেন যত না, তার চেয়ে বেশি বলকে ব্যাট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতেন। গবেষণা বলছে, ব্র্যাডম্যান তাঁর নিজস্ব রোটারি পদ্ধতি স্ট্রোকমেকিংয়ে ব্যবহার করতেন। যা তৈরি হয়েছিল তাঁর বাউরালের বাড়িতে জলের ট্যাঙ্কে গল্ফ বল ছুড়ে স্টাম্প দিয়ে ফেরানোয়।
সকাল থেকে সচিন যেমন অনবদ্য চিত্রকলার মতো তাঁর স্ট্রোক সৌকুমার্য দেখানো শুরু করলেন, মনে হচ্ছিল সত্যিই তো ব্র্যাডম্যান এত নিখুঁত, ব্যাকরণভিত্তিক ছিলেন না। সচিন কাল ৪২ বল খেলে অসহ্য ৮ রানে অপরাজিত ছিলেন। আজ ৯৯ বলে ৭২ করলেন। ভাল খেলতে খেলতে সত্তরের ঘরে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। সচিনের বেশ কিছু দিন হল হঠাৎ হঠাৎ এই স্বআরোপিত স্পিডব্রেকার ফেলে দেওয়া ঘটছে। আর তখনই তাঁর আউট হয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা। আজ যেমন ক্লার্ককে ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ উইকেটটা দিয়ে দিলেন।
শাস্ত্রী: খুব পরিষ্কার যে, শততম সেঞ্চুরির চাপ ওকে ষাট পেরনোর পর খেলতে দিচ্ছে না।
সৌরভ: এই যে হঠাৎ হঠাৎ আটকে যাচ্ছে কোনও মানে হয়? ক্লার্ককে তো ইজিলি স্টেপ আউট করে বাইরে ফেলে দিতে পারত।
ইয়ান চ্যাপেল: ফিফ্থ গিয়ার থেকে ফোর্থ গিয়ার ঠিক আছে। কিন্তু ফার্স্ট গিয়ার কেন তা বলে?
ডিন জোন্স: অনবদ্য ব্যাট করছে। কিন্তু প্রতি বার সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে বেশি সতর্ক হয়ে পড়ছে। চাপ-চাপ।
সিডনি মাঠের মহা পরিচালক গ্রাউন্ডস ট্রাস্ট কমিটির চেয়ারম্যান এবং আদ্যন্ত ক্রিকেট রোমান্টিক রডনি ক্যাভেলিয়ারকে পেলাম ম্যাচ শেষে। সচিনের সেঞ্চুরি নিয়ে সেই কবে থেকে যিনি শশব্যস্ত হয়ে রয়েছেন। তা ক্যাভেলিয়ার নিশ্চয়ই খুব দুঃখিত।
বললেন, “না না, ভিক্টর তো এই খেলাই দেখতে চান। কে হারল, কে জিতল-তে ওঁর কিছু আসে যায় না। উনি বিশ্বাস করেন ব্যাটিংয়ের স্পিরিটে। যেটা সচিন দেখাল।”
ভিক্টর মানে ভিক্টর ট্রাম্পার। হ্যাঁ, মারা গিয়েছেন ১৯১৫ সালে। সিডনি মাঠের লোকগাথা অনুযায়ী সিডনি টেস্টের চতুর্থ দিন খেলা দেখতে আসেন। খুঁজে বার করেন, কে ক্রিকেটের প্রকৃত স্পিরিট মেনে খেলছে।
০-২-এর বেদনার পেয়ালাতেও ট্রাম্পারের ছবি। সফরে ৫৬ গড় নিয়ে ২২৫ রান করে ফেলেছেন বলে নয়। সিডনি দলের বাকি দশ জনের মতো সচিনের ব্যক্তিগত সিরিজ জেতার স্বপ্ন মুছে দেয়নি! তাঁর দ্বারা মহাসীমান্ত এখনও অতিক্রম হওয়া সম্ভব পার্থ আর অ্যাডিলেডে। ভারত নিরঙ্কুশ হারল। সচিন এখনও অপরাজিত।

স্কোরবোর্ড
অস্ট্রেলিয়া
প্রথম ইনিংস: ৬৫৯-৪ ডিঃ
ভারত
প্রথম ইনিংস: ১৯১
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস
(আগের দিন ১১৪-২)
গম্ভীর ক ওয়ার্নার বো সিডল ৮৩
সচিন ক হাসি বো ক্লার্ক ৮০
লক্ষ্মণ বো হিলফেনহস ৬৬
কোহলি এলবিডব্লিউ প্যাটিনসন ৯
ধোনি ক ও বো হিলফেনহস ২
অশ্বিন ক লিয়ঁ বো হিলফেনহস ৬২
জাহির ক মার্শ বো সিডল ৩৫
ইশান্ত এলবিডব্লিউ লিয়ঁ ১১
উমেশ নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ১৯
মোট ১১০.৫ ওভারে ৪০০।
পতন: ১৮, ১০০, ১৬৮, ২৭১, ২৭৬, ২৮৬, ২৮৬, ৩৪২, ৩৮৪।
বোলিং: প্যাটিনসন ২৩-৪-১০৬-১, হিলফেনহস ৩২.৫-৮-১০৬-৫
সিডল ২৪-৮-৮৮-২, লিয়ঁ ২০-২-৬৪-১, ক্লার্ক ৯-০-২২-১, হাসি ২-০-৫-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.