কলিকাতার ফুটপাথ ও ব্যস্ত রাজপথগুলিকে হকার-মুক্ত করার কথা যে ইদানীং কোনও রাজনৈতিক দলই আর উচ্চারণ করে না, তাহার কারণ স্বনিযুক্ত এই লক্ষ-লক্ষ মানুষের প্রতি মানবিক দরদ নয়। হকার-তোষণের কারণ, তাঁহারা নির্বাচনী রাজনীতিতে সব দলেরই সম্পদ। তাই কলিকাতার ফুটপাথ সর্বত্র দখল হইয়া গিয়াছে। দখলদাররা রাজনৈতিক দলের ইউনিয়নে সংঘবদ্ধ। তাই তাঁহাদের উচ্ছেদের প্রশ্নও ওঠে না। এই প্রেক্ষিতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ঘোষণাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এস এস কে এম হাসপাতাল ও গোখেল স্কুলের সামনে হকারদের ভিড় দেখিয়া তিনি তাহা তুলিয়া দিতে নির্দেশ দেন। তাঁহার কথায়, নূতন করিয়া শহরের কোনও এলাকায় হকার বসিতে দেওয়া হইবে না, কেননা বিরোধী দল সি পি আই এম তাঁহার সরকারকে বিব্রত করিতেই হকার বসাইতেছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশ ওই হাসপাতাল ও স্কুল চত্বরকে দখলমুক্ত করিয়াছে, হকার ইউনিয়নের প্রতিবাদী বিক্ষোভ সত্ত্বেও পুনর্দখল করিতে দেয় নাই।
এই কঠোরতা স্বাগত। কিন্তু পুরাতন হকারদের ক্ষেত্রে জবরদখল শিরোধার্য আর নূতন হকারদের ক্ষেত্রে নয়, এই নীতি কেমন করিয়া কার্যকর হইবে? পুরাতন-নূতনের কোনও হিসাব বা তালিকা কি পুরসভার কিংবা পুলিশের আছে? পুরাতন হকাররা জবরদখল করা ফুটপাথও নূতন হকারদের ভাড়া দিয়া থাকেন, তাহারই বা কী মীমাংসা হইবে? সর্বোপরি কার্যত গোটা শহরই যে হকারদের দখলে চলিয়া যাইতেছে, ফুটপাথে এমনকী বুড়ো আঙুলে ভর দিয়াও পথচারীরা হাঁটিতে পারিতেছেন না, উপরন্তু ফুটপাথ উপচাইয়া রাস্তার অনেকটাও উত্তরোত্তর দখল হইয়া যান-চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট পরিসর সঙ্কুচিত করিয়া দিতেছে এই অরাজক উচ্ছৃঙ্খলতার কি কোনও সুরাহা হয় না? রাজপথ ও ফুটপাথগুলি কি যানবাহন ও পথচারীদের জন্য নির্মিত হয় নাই, নির্মিত হইয়াছে এই স্বনিযুক্ত হকার-বিক্রেতাদের জন্যই?
মুখ্যমন্ত্রী বলিয়াছেন, তিনি হকারদের পক্ষে (কেবল সি পি আই এমের বসানো নূতন হকারদের পক্ষে নন)। এই ‘পক্ষপাতিত্ব’কে একটি যুক্তিসঙ্গত রূপ দিতে চাহিলে হকারদের পুনর্বাসনের কথা তিনি ভাবিতেই পারেন। কাজটি কঠিন। প্রসঙ্গত, পুনর্বাসনের নামে ইতিপূর্বে যে পরিকাঠামো পুরসভা নির্মাণ করিয়া দিয়াছিল, হকাররা সেখানে যাইতে অস্বীকার করেন, কেননা, তাঁহাদের মতে, সেটা ছিল ‘নির্বাসন’। শহরের প্রায় চার লক্ষ হকারকে কোনও জমজমাট বাজার বা বাণিজ্যক্ষেত্রে পুনর্বাসন দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? সকলেই তো শহরের কেন্দ্রস্থলে আসিয়া পসরা সাজাইতে চাহিবে! যদি একটি এলাকা হইতে হকারদের তুলিয়া অন্যত্র বসানো হয়, তবে কি সেই এলাকা খালি পড়িয়া থাকিবে? পত্রপাঠ অন্য স্বনিযুক্তরা হকারির পসরা লইয়া সেই শূন্যস্থান ভরাইয়া ফেলিবে, যদি না পুলিশ ও প্রশাসন কঠোর হয়। সেই কঠোরতা আবার ‘মানবিকতা-বিরোধী’ বলিয়া ধিক্কৃত হইতে পারে। প্রথম পর্বে অন্তত কিছু নির্দিষ্ট এলাকাকে হকার-মুক্ত রাখিতে সরকারকে দৃঢ়তা দেখাইতে হইবে, এবং সেই দৃঢ়তা দলনিরপেক্ষও হওয়া চাই। ‘সি পি আই এমের বসানো হকার’ হইলে তুলিয়া দিব, আর তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগামী হইলে আসন পাতিয়া দিব এ রূপ পক্ষপাত প্রশাসনের সাজে না। |