যাদবপুর বিদ্যাপীঠের পর রায়গঞ্জ কলেজ। প্রথমটিতে প্রধান শিক্ষককে মারধর করা হয়, দ্বিতীয়টিতে অধ্যক্ষকে। এই নিগ্রহ যূথবদ্ধ এবং রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়পুষ্ট দুর্বৃত্তবাহিনীর। উভয় ক্ষেত্রেই অভিযোগের তির রাজ্যের শাসক দলের দিকে, যাহার কাউন্সিলর ও জেলা স্তরের নেতারা অকুস্থলে উপস্থিত থাকিয়া সমগ্র অপকাণ্ড সঞ্চালন করিয়াছেন। এবং লক্ষণীয়, উভয় ক্ষেত্রেই দুই-এক জন দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করিলেও পুলিশ প্রকৃত মাতব্বরদের কেশাগ্রও স্পর্শ করে নাই। সংবাদপত্রে এবং বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে এই নিগ্রহের পূর্বাপর ঘটনাক্রম সমগ্র রাজ্যবাসী বিস্ফারিত নেত্রে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, কেবল পুলিশই ঘটনাস্থলে মোতায়েন থাকিয়াও কিছু দেখিতে পায় নাই। এই সংশয় স্বাভাবিক যে, তবে কি রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, যাহার নির্দেশ ছাড়া পুলিশ ‘নিরপেক্ষ’ হইতে পারে না, তাহাদের চোখে হাত-চাপা দিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন? তাই রায়গঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষকে যখন ছাত্র নামধারী কতগুলি দলীয় দুষ্কৃতী জামার কলার ধরিয়া টানিয়া-হিঁচড়াইয়া কলেজ চত্বরে বেধড়ক প্রহার করিতেছিল, পুলিশ তখন দৃশ্যত তাঁহাকে রক্ষা করা অপেক্ষা লাঠি উঁচাইয়া প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলকে আটকাইতে ব্যস্ত থাকিয়াছে। বিদ্যায়তনে এই ভৈরব-তাণ্ডব ও তাহার মোকাবিলায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের লজ্জা।
রাজ্য সরকার বলিয়াছে, তাহারা শিক্ষাক্ষেত্র হইতে দলতন্ত্র উচ্ছেদ করিবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাইতেছে, শিক্ষায়তনে দলতন্ত্রের উপদ্রবের বিরাম নাই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ঘেরাও, জঙ্গিপুর, বহরমপুর, শ্রীচৈতন্য কলেজ, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ, ফকিরচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষের ঘরে ভাঙচুর, অধ্যাপকদের মারধর-ঘেরাও, অশোকনগর ও গুমার স্কুলের প্রধান শিক্ষককে মারধর এ ভাবেই কি শিক্ষা হইতে দলতন্ত্র রদ হইতেছে? গায়ের জোরে, মারপিট করিয়া, পুলিশ প্রশাসনকে ঠুঁটো দাঁড় করাইয়া স্কুলের পরিচালন সমিতি ও কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন দখল করার এই ঐতিহ্য তো তবে অপরিবর্তিতই রহিয়া গেল। ষাট-সত্তরের দশকে কলেজ স্ট্রিটে বিবিধ ছাত্র সংগঠনের যে তাণ্ডব দেখা যাইত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সন্তোষ ভট্টাচার্যের সহিত বামপন্থী ছাত্র-কর্মচারীরা যে অশালীন গুণ্ডামি করিয়াছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র-যুবরা কি তাহার পাল্টা দিতেছেন? শিক্ষার অঙ্গনে তো তবে মত্ত হস্তীদের দাপাদাপিই দস্তুর হইয়া উঠিবে।
এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব একমাত্র ছাত্র-রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করিয়া। যত দিন স্কুল-কলেজে দলীয় রাজনৈতিক প্রাধান্য কায়েম করার তাগিদ থাকিবে, তত দিন বিদ্যাস্থানগুলি অবিদ্যাপারঙ্গম রাজনৈতিক বাহুবলীদের অবাধ লীলাক্ষেত্র হইয়া থাকিবে। তবে সেই পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। আশু কর্তব্য প্রশাসনের। রায়গঞ্জের মতো ঘটনা কঠোর হস্তে নিবারণ এবং দমন করা প্রশাসনের প্রাথমিক দায়িত্ব। সেই কঠোরতা হওয়া উচিত সম্পূর্ণ দলনিরপেক্ষ, তাহা না হইলে প্রশান কথাটিরই কোনও অর্থ থাকে না। পশ্চিমবঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ইদানীং দৃশ্যমান, রাজ্যব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে অনিয়ন্ত্রিত তাণ্ডব এবং তাহার সপক্ষে অবলম্বিত নীরবতা-নিষ্ক্রিয়তা ও অনুতাপহীন কৈফিয়তের সঙ্গে সেটা একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুরুতেই যদি রাজ্যের শাসন-কর্তৃপক্ষ এই গুণ্ডামির সংস্কৃতি কঠোর হস্তে দমন না করেন, তবে পরে আর তাহা নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে না। পড়াশুনার কেন্দ্রগুলি যাহাতে রাজনৈতিক (বা অরাজনৈতিক) গুণ্ডাদের স্বেচ্ছাচার ও দখলদারি হইতে মুক্ত থাকে, তাহা নিশ্চিত করা দরকার। মুখ্যমন্ত্রী সতর্ক হউন। তৎপর হউন। তাঁহার দল ও প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতার কিন্তু দ্রুত অধঃপতন ঘটিতেছে। |