সর্বদল বৈঠকের আগের দিন বিষমদ-কাণ্ড মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের ‘ব্যর্থতা’র বিরুদ্ধে সরব হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএমের নদিয়া জেলা সম্মেলন উপলক্ষে রবিবার কৃষ্ণনগরে সমাবেশ-মঞ্চ থেকে বুদ্ধবাবুর অভিযোগ, চিকিৎসার গাফিলতিতেই বিষ মদের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা এত বেড়েছে। তিনি বলেন, “মদ খেয়ে সংগ্রামপুরে এতগুলো মানুষ মারা গেল। মদ খেয়ে গরিব মানুষই মারা যায়। সচেতন করতে সময় লাগে। গ্রাম থেকে অসুস্থ মানুষগুলোকে আনার মতো অ্যাম্বুল্যান্স নেই! চিকিৎসাই হল না। বিনা চিকিৎসায় এতগুলো মানুষ মারা গেল। এ ভাবে চলতে পারে না!”
বিষমদ-কাণ্ডে বহু মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে আজ, সোমবারই বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে সর্বদল বৈঠক বসার কথা। মাতৃবিয়োগের দরুন মুখ্যমন্ত্রী নিজে অবশ্য সেই বৈঠকে থাকতে পারবেন না। ঘটনার তদন্ত চলাকালীনই রাজ্যের মন্ত্রী এবং তৃণমূলের নেতারা যে ভাবে মদে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে এত মানুষের মৃত্যু ঘটানোর জন্য সিপিএমকেই সরাসরি দোষী করেছেন, তার জেরে বিরোধী বামফ্রন্ট শিবির সর্বদলে যোগ দেবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বিধানসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার পর আজ সরকার পক্ষ কী ভূমিকা নেয়, তা দেখেই তাঁদের অবস্থান চূড়ান্ত করবেন বাম পরিষদীয় নেতৃত্ব। |
কৃষ্ণনগরে সিপিএমের জেলা সম্মেলনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য |
বিষমদ-কাণ্ড সামাল দিতে রাজ্য সরকারের ‘ব্যর্থতা’র বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর সিদ্ধান্ত শনিবারই নিয়েছিল বামফ্রন্ট। সেই অনুযায়ীই এ দিন দলের মঞ্চ থেকে সরব হয়েছেন বুদ্ধবাবু। সমালোচনা করেছেন মগরাগাট-কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকারও। তাঁর কথায়, “একটা গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। পুলিশ এল। কারও সঙ্গে কোনও কথা বলল না। গুলি চালাল! মানুষ মরল!” আর আমরি-কাণ্ড প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “একটা নার্সিংহোমে আগুন লাগল। মানুষ মারা গেল। কারা গাফিলতি করল? কী ভাবে আগুন লাগল? কেন আগুন লাগল? তা ভাল করে তদন্ত করে দেখতে হবে।”
ক্ষমতাচ্যুত সিপিএমকে আপাতত ১০ বছর চুপ করে থাকার যে ‘পরামর্শ’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিয়েছেন, তা তাঁরা মানবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। বলেছিলেন, ‘জন-বিরোধী’ নীতি এবং ‘ব্যর্থতা’ দেখলে তাঁরা অবশ্যই সরব হবেন। সেই কথাই এ দিন ফের স্মরণ করিয়ে রাজ্যের শিল্পায়ন এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের ‘সঙ্কটজনক’ পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা। শীতকাল, তাই বুঝতে পারছেন না। আমরা একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছিলাম। কাটোয়াতে জমি নেওয়া কিছুটা বাকি ছিল। সেখানে কারখানা হবে না বলে দিয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যও জমি নেবে না! তা ছাড়া, কয়লার দামও বাড়ছে। কয়লার দামও দিতে পারছে না। বিদ্যুৎ নিয়ে কঠিন অবস্থা হবে।”
জমি-সূত্রেই শিল্পায়নের সমস্যার কথা বলেছেন বুদ্ধবাবু। রাজ্যে কারখানা তৈরি ও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এ দিনও ফের মুখ খোলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “কেউ কারখানা করতে আসবে না। কারণ, জমি পাওয়া যাবে না। আর জমি না-পেলে কারখানা কোথায় হবে? শিল্পপতিরা আসবেন না!” তাঁর আরও মন্তব্য, “৭ মাস সরকার হল। কারখানার কী হবে? আমরাই উদ্যোগী হয়েছিলাম। কিন্তু গোলমালে আটকে গেল। হলদিয়া, খড়্গপুর আমরাই করেছি। শালবনিতে সব চেয়ে বড় ইস্পাত শিল্পের উদ্যোগ হয়েছিল। তার পরে আর কিছু হয়নি!”
নতুন সরকারের জমানায় প্রায়শই ‘বিতর্ক’ বাধছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। তার জন্য তৃণমূলকে দায়ী করেছেন বুদ্ধবাবু। তাঁর মতে, “কাজের কাজ না-করে ওরা অকাজ করতে ওস্তাদ! এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আইনে চলত, সেটা বাতিল করেছে। তৃণমূল বলছে, দলবাজি করবেন না। অথচ ওদের দলবাজির জন্য চার দিক অন্ধকার! আসলে ওরা ছাড়া কেউ দলবাজি করবে না! ওরা বলছে, উপাচার্য ওরা ঠিক করবে। ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্রেরা থাকবে না। তা হলে থাকবে কে? তৃণমূলের সাংসদ আর বিধায়কেরা বিশ্ববিদ্যালয় চালাবেন! তা হয়?”
নতুন রাজ্য সরকারের জমানায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ধানের দাম না-পাওয়া এবং সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের দুর্দশা, কেন্দ্রীয় সরকারের একপেশে আর্থিক নীতি এ সবের বিরুদ্ধেই লাগাতার আন্দোলনের পথে থাকার কথা বলেছেন বুদ্ধবাবু। পাশাপাশিই, আত্মসমালোচনা করে বলেছেন সম্মেলন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলের ‘ভিতরের অন্যায়’ দূর করার কথা। দলের এই পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “কিছু মানুষ কমিউনিস্ট পার্টি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। টাকার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি করা যাবে না। এই সব লোককে বাদ দিতে হবে। আমাদের কর্মীর অভাব হবে না!” তিনি সাফ বলেন, সরকারে থাকতে থাকতে ‘কিছু মাতব্বর’ হয়েছে। তার জন্য মানুষ শাস্তি দিয়েছেন এবং তাঁরা মেনে নিয়েছেন। নদিয়া জেলা সম্মেলন চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত। |