গোটা দুনিয়ার অর্থনীতিই বেহাল, তাহার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থা প্রায় অবর্ণনীয়। দেনার দায়ে গ্রিসের নাভিশ্বাস উঠিতেছে; ইতালি, পর্তুগাল, স্পেন, আয়ার্ল্যান্ডও রোগশয্যায়। মানুষ তিক্তবিরক্ত। গ্রিস এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রীরা পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। যে দুইটি দেশ এখনও অবধি ইউরোপের রক্ষাকর্তা, সেই জার্মানি এবং ফ্রান্সেও জনমত ক্রমে সরকারের বিপক্ষে ঘুরিতেছে। এই বিপর্যয়ের উৎস অতীতে, ইউরো অঞ্চলের পরিকল্পনায়। এই অঞ্চলের মুদ্রা অভিন্ন। তাহার ফলে এক দেশের ব্যাঙ্ক হইতে অন্য দেশের পক্ষে ঋণগ্রহণ কার্যত বাধাহীন ছিল। গ্রিসের ন্যায় দেশ এই ব্যবস্থার পূর্ণ ব্যবহার করিয়াছে। সেই অর্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেহারাটি একটি দেশের ন্যায়। কিন্তু, সেই ‘দেশ’টির কোনও অভিন্ন রাজস্ব নীতি ছিল না। ফলে, অঞ্চলের অন্তর্গত দেশগুলি আর্থিক উচ্ছৃঙ্খলতার শিকার। তাহার ফল এই বিপর্যয়। বহু বিলম্বে ব্রাসেলস-এর হুঁশ হইয়াছে। কয়েক মাস পূর্বে ‘সিক্স প্যাক’ নামক একটি রাজস্ব নীতি প্রস্তাবিত হইয়াছিল। ইউরো অঞ্চলের দেশগুলি যাহাতে একটি নির্দিষ্ট রাজস্ব নীতি মানিয়া চলে, কোনও দেশ সেই নীতি হইতে বিচ্যুত হইলে তাহার বিরুদ্ধে যাহাতে ব্যবস্থা করা যায় তাহা নিশ্চিত করিতেই এ প্রস্তাব। ব্রাসেলস-এ যে বৈঠকে প্রস্তাবে সিলমোহর পড়িবার কথা, সেখানে ব্রিটেন বাঁকিয়া বসিল। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলিলেন, প্রস্তাবটি ব্রিটেনের স্বার্থবিরোধী, ফলে তিনি ইহা মানিতে অপারগ। ইহাতে ফ্রান্স মর্মান্তিক ক্ষিপ্ত, তাঁহার সরকারের শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও ক্ষুব্ধ। ব্রিটেন ইউরো অঞ্চলের সদস্য না হইলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। ক্যামেরনের সিদ্ধান্ত ভূ-রাজনীতিতে ব্রিটেনকে নিঃসঙ্গ করিতেই পারে।
ক্যামেরন তাঁহার সিদ্ধান্তের সমর্থনে কিছু যুক্তি খাড়া করিয়াছেন। কিন্তু, প্রকৃত কারণটি তিনি স্বভাবতই উল্লেখ করেন নাই। সেই কারণটির নাম দ্বীপমণ্ডূকতা। ইহা এক বিশেষ মানসিক অবস্থা। ভৌগোলিক ভাবে দেশটি একটি দ্বীপ, জলবেষ্টিত। ফলে, তাহার অধিবাসীরা, ঐতিহাসিক ভাবেই, একা বাঁচিতে অভ্যস্ত। অন্য দিকে, কোনও এক সময় ব্রিটেনের নামের পূর্বে ‘গ্রেট’ শব্দটি বসিত। ঔপনিবেশিক শক্তি হিসাবে দেশটি অগ্রগণ্য ছিল। ফলে ব্রিটেন, এবং তাহার অধিবাসীরা যে অন্যদের তুলনায় পৃথক, উচ্চবর্ণ, এই বিশ্বাস ব্রিটিশ চরিত্রে প্রোথিত হইয়াছিল। ‘গ্রেট’ উপাধি এবং উপনিবেশের গর্ব, উভয়ই খসিয়া যাওয়ার পরেও টেমস দিয়া বহু জল বহিয়া গিয়াছে, কিন্তু ব্রিটিশ মন বদলায় নাই। সেই মনটিই ক্যামেরনকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তিতে স্বাক্ষর করিতে বাধা দিয়াছে। ইহা রক্ষণশীলতা। কিন্তু, এই রক্ষণশীলতাটি ‘কনজার্ভেটিভ পার্টি’-র একচেটিয়া নহে। যে লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড আজ ক্যামেরনের সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছেন, তাঁহার দল ক্ষমতায় থাকিবার সময় ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশী হইয়াও একটি দূরত্ব বজায় রাখিয়াই চলিয়াছিল। ব্রিটেনের রাজনীতিকদের ভাবিতে হইবে, তাঁহারা কি অতীত-গরিমায়-উদ্ভাসিত এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাগরিক হইয়াই থাকিতে চাহেন, না কি ইউরোপের ভূ-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হইয়া উঠিবার বাসনা রাখেন? যদি দ্বিতীয়টিই কাম্য হয়, তবে ক্যামেরনের সিদ্ধান্তটি ভ্রান্ত। এই বিপর্যয়ের বাজারে তাঁহাদের স্বার্থ অবশিষ্ট ইউরোপ হইতে পৃথক হইতে পারে না। ইউরোপ ডুবিলে ব্রিটেনও বাঁচিবে না। |