গার্গী গুহঠাকুরতা • কলকাতা |
শান্তনু চট্টোপাধ্যায়। বয়স ৪৫। যক্ষ্মা ও মেনিনজাইটিসের চিকিৎসা করাতে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকুরিয়া আমরিতে। দুর্ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও পড়েছিলেন অন্য বিপদে। বি আর সিংহ হাসপাতালে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, শান্তনুর আগের চিকিৎসা কোন পথে হয়েছে তার কোনও নথিই নেই। নেই এমআরআই-সহ কোনও জরুরি রিপোর্ট। কোথা থেকে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তা নিয়েই ধন্দে পড়ে যান তাঁরা। আমরির চিকিৎসকের ফোন নম্বর জোগাড় করে এ যাত্রায় হয়তো সমস্যার সুরাহা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে ফের প্রশ্ন উঠেছে, এ রাজ্যে রোগীদের ইলেকট্রনিক মেডিক্যাল রেকর্ড রাখতে হাসপাতালগুলির এই গড়িমসি কেন?
অগ্নিকাণ্ড বা কোনও দুর্ঘটনায় তথ্য হারিয়ে যাওয়া না হয় আলাদা কথা। কিন্তু আমরির ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, রোগীর চিকিৎসার তথ্য ‘ব্যাক আপ’ বা বিকল্প ব্যবস্থা-সহ কম্পিউটারে রাখার ঐতিহ্যই তৈরি হয়নি রাজ্যের বেশির ভাগ হাসপাতালে। নিয়ম আছে, কিন্তু খাতায়-কলমে। অথচ রেকর্ড রাখা যে কত জরুরি, তা শান্তনুবাবুর আত্মীয় অর্ধেন্দু শর্মার কথাতেই স্পষ্ট। তিনি বলেন, “ভাগ্যক্রমে আমরির চিকিৎসকের নম্বর পাই। তাই চিকিৎসা শুরু করতে পেরেছিলেন বি আর সিংহের চিকিৎসক।” একই কারণে হন্যে হয়ে আমরির ডাক্তারদের নম্বর খুঁজছেন অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত রোগীদের আত্মীয়রা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন দেশে রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য নথিবদ্ধ রাখা বাধ্যতামূলক। এই কড়াকড়ির দৌলতেই ভারতে স্বাস্থ্য বিষয়ক আউটসোর্সিং (মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশন)-এর রমরমা। এ ধরনের সংস্থা রয়েছে কলকাতাতেও। যেমন, রোগীদের চিকিৎসার তথ্য ধরে রাখতে ভুবনেশ্বর ও কলকাতায় সংস্থার শাখা খুলেছেন বস্টনের চিকিৎসক অরবিন্দ চক্রবর্তী। অর্থাৎ, খাস কলকাতাতেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে মার্কিন রোগীদের তথ্যভাণ্ডার। অথচ প্রয়োজনীয় তথ্য নেই এ রাজ্যের অধিকাংশ বাসিন্দারই। এই পথে আগেই পা বাড়িয়েছে অ্যাপোলো-সহ দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু হাসপাতালও। কিন্তু এ রাজ্যে যে ক’টি হাসপাতালের হাতে এই তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তারা ব্যতিক্রম বললেই চলে।
তথ্যভাণ্ডার নিয়ে এমন ঢিলেঢালা মনোভাব কেন? চিকিৎসকদের দাবি, মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার ২০০২ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী, অন্তত তিন বছরের প্রেসক্রিপশন কম্পিউটারে রাখার কথা হাসপাতালগুলির। কিন্তু এ নিয়ে বিদেশের মতো এখানে কোনও আইনি কড়াকড়ি নেই। তাই এই হাল। শহরের একটি ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রধান অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এ বিষয়ে নির্দেশিকা থাকলেও আইন নেই। ফলে রেকর্ড নেই অধিকাংশ হাসপাতালেই।”
তা হলে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কী ভাবে গড়া যাবে তথ্যভাণ্ডার? এই ক্ষেত্রে দু’দশকেরও বেশি কাজ করা মনীষা চৌধুরী বলেন, “একটি মূল তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে হবে। হাসপাতালের নিজস্ব রেকর্ডের পাশাপাশি যেখানে রাখা থাকবে যাবতীয় তথ্য। যাতে যে কোনও জায়গা থেকে যে কোনও সময় সেখান থেকে তথ্য পেতে পারেন চিকিৎসক বা রোগী। বিদেশে এই ব্যবস্থাই চালু।” এতটা করা না-গেলে, প্রাথমিক ভাবে অন্তত হাসপাতালের নিজস্ব তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থায় এই তথ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব বলে তাঁর দাবি। অবিলম্বে এই ব্যবস্থা চালু হওয়া জরুরি বলে মত চিকিৎসক শতদল সাহারও।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম-ও। তার পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা সুপর্ণ মৈত্র জানান, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে তৈরি হয়েছে স্টেট ডেটা সেন্টার (মণিভাণ্ডার)। একই ভাবে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব তথ্য ধরে রাখতেও এ ধরনের কেন্দ্র গড়া বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে তাঁর দাবি। |