ব্যতিক্রম হল না এ বারও!
শহরে একটা করে বিপর্যয় হয়, আর দায় এড়াতে কমিটি, পরিদর্শক দল গড়ার হিড়িক পড়ে যায় প্রশাসনে। বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থাগুলির পরিকাঠামোর খোলনলচে বদল করার সুপারিশ হয়। পুলিশ অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। মন্ত্রীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন। কিন্তু আরও একটা অঘটনের পরে দেখা যায়, আগের সুপারিশ ফাইলবন্দি হয়েই রয়েছে। মানা হয়নি কিছুই। যাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়, তারাই আবার পুরনো ব্যবসা চালু করে দেয়।
নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্টে আগুন লাগে বাম সরকারের আমলে। আমরি হাসপাতালে আগুন লাগল পরিবর্তনের পরে, নয়া সরকারের সময়। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে পুরনো রোগটা যায়নি। তাদের বিধি যথাযথ মানা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে দমকল ফের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়েছে। স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতালে পরিদর্শক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সব হাসপাতালে বেসমেন্টের ব্যবহার যথাযথ কি না, দফতরের কর্মীরা তা দেখবেন।
যে কাজগুলি করা হবে বলে শনিবার তিনটি দফতর ঘোষণা করেছে, সেগুলি প্রাত্যহিক কাজেরই অঙ্গ। তাই ঘটা করে ফের ঘোষণার কী দরকার ছিল, সেই প্রশ্ন উঠছেই।
দমকলমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণার কথাই ধরা যাক। গত বছর মার্চ মাসে স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পরে দমকল-পুলিশকে নিয়ে কমিটি গড়া হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল শহরের বিভিন্ন বাজার এবং ‘বিপজ্জনক’ বহুতল পরিদর্শন করে নির্দিষ্ট সুপারিশ করা। হাসপাতালের কথাই শুধু বলা ছিল না। সেই কমিটি কিন্তু রয়েছে এখনও। তা বাতিল না করেই আর একটি পরিদর্শক কমিটি গড়ে দিলেন দমকলমন্ত্রী! হাসপাতাল-সহ শহরের প্রতিষ্ঠানে (বাজার, বহুতল, পুরনো বাড়ি) অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঘুরে দেখে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দেবেন তাঁরা।
পুরনো কমিটিতে দমকলের ডেপুটি ডিরেক্টর পর্যায়ের এক অফিসার ছিলেন। নতুন কমিটিতে রয়েছেন এডিজি। নতুন কমিটির কাজটাও এক। তা হলে একই কাজের জন্য নতুন কমিটি কেন? দমকলমন্ত্রী জাভেদ খানের ব্যাখ্যা, “কাগজে কলমে আগের কমিটির অস্তিত্ব রয়েছে। তারা কয়েকটি রিপোর্টও দিয়েছে। কিন্তু এখন ওরা কাজ করছে না। তাই আমরা আমাদের দফতরের অফিসারদের নিয়ে নতুন দল গড়েছি। নাম, ফায়ার সেফটি অডিট কমিটি।” তা হলে পুরনো কমিটির কী হবে? দমকলমন্ত্রীর জবাব, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অন্য জায়গায়। ফায়ার লাইসেন্স দেওয়া এবং নবীকরণ নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন সংস্থার অভিযোগ অনেক দিনের। সেই কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত তাঁদের দিয়েই পরিদর্শক কমিটি কী ভাবে করা হল, তা নিয়ে দমকলের অফিসারদের একাংশই সরব হয়েছেন। তাঁরা চাইছেন নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করানো হোক। দমকলমন্ত্রী বলেন, “কমিটিতে প্রাক্তন অধিকর্তা বরেন সেনকে রাখা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বলে শুনিনি। আর কমিটির প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তবে তাঁকে বদলে দেব।” মন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণায় নতুনত্ব একটাই। দমকলের ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং করা হবে বলেও তিনি জানান।
পুরনো সিদ্ধান্ত নবীকরণে পিছিয়ে নেই স্বাস্থ্য দফতরও। বিভিন্ন হাসপাতাল ঠিক পরিষেবা দিচ্ছে কি না, তাদের উপযুক্ত পরিকাঠামো রয়েছে কি না দেখতে ‘ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট’ আইন রয়েছে রাজ্যে। বিভিন্ন সময় তা সংশোধনও করা হয়েছে। শনিবার স্বাস্থ্য দফতর জরুরি বৈঠক ডেকে জানিয়ে দিয়েছে, রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালগুলির (যেগুলির লাইসেন্স এক বছর আগে পুনর্নবীকরণ হয়েছে) প্রত্যেকটিতে দফতরের প্রতিনিধিরা পরিদর্শনে যাবে। আমরির সব ক’টি শাখাতেও যাবে স্বাস্থ্য দফতরের পরিদর্শক দল।
তবে কি এত দিন ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট আইন ঠিক ভাবে মানা হচ্ছিল না? স্বাস্থ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র বলেন, “একেবারে যে হয়নি তা নয়। তবে চিকিৎসকদের একাংশের বাধায় পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। এ বার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই আইন মানাতে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” স্বাস্থ্য দফতর থেকে বলা হয়, ২০১০ সালে ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট নতুন আইন কার্যকর হলেও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনও বিধি তৈরি হয়নি। বিধি তৈরির কাজ চলছিল। আমরির ঘটনার প্রেক্ষিতে আগামী বিধানসভা অধিবেশনেই নতুন বিধি আনার চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য দফতর।
এ দিন বৈঠকে জেলাগুলির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের স্বাস্থ্যসচিব বলেন, “হাসপাতাল নিয়ম না মেনে পরিষেবা দিলে লাইসেন্স বাতিল করুন।” কিন্তু অনেক স্বাস্থ্য-কর্তারই প্রশ্ন, এটাই তো নিয়ম। এতদিন তা মানা হয়নি কেন? স্বাস্থ্য-কর্তারা রাজনৈতিক চাপের প্রসঙ্গ তোলেন। স্বাস্থ্যসচিব জানিয়ে দেন, নিয়ম মেনে কাজ চলুক। স্বাস্থ্য দফতর তাঁদের পাশে থাকবে।
শুক্রবারই অগ্নিদগ্ধ আমরির লাইসেন্স বাতিল করে স্বাস্থ্য দফতর। শনিবার তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করল কলকাতা পুরসভা। নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের পরে যে সমস্যাটি নজরে এসেছিল, তা নিয়েও ফের সরব হয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “বাড়ির কপ্লিশন সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়ার পরে বাড়ির ভিতরে কী হচ্ছে তার খবর পুরসভা রাখে না। দমকলের দেওয়া তথ্যের উপরে নির্ভর করতে হয়। তাতেই সমস্যা হচ্ছে। এখন থেকে পুরসভা ও দমকলের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা হবে।”
মেয়র বলেন, “আমরির ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরেই শহরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে কী করণীয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।” কিন্তু এটাই তো পুরসভার কাজ। তবে এই সিদ্ধান্তে নতুনত্ব কী আছে? মেয়র বলেন, “শুধুমাত্র মুখরক্ষার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। যে ব্যবস্থাই নেওয়া হোক, দৃঢ় ভাবে তা কার্যকর করা হবে।” এ দিন যে সব ঘোষণা হল তা ফাইল বন্ধ থাকবে, না কার্যকর হবেপ্রশ্ন সর্বত্রই। কারণ, এ ব্যাপারে রাজ্যের মানুষের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্টের অভিজ্ঞতা বলছে, কিছু দিনের মধ্যেই ওই ফাইলে ধুলো জমবে। ফাইলে ফের হাত পড়বে হয়তো। কিন্তু আরও একটা অঘটনের পরে।
|
সব ঘটে যাওয়ার পরে |
স্বাস্থ্য দফতর |
• নিয়ম মেনে পরিষেবা না দিলে লাইসেন্স বাতিল
• রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নোয়ানো নয়
• রাজ্যের সব বেসরকারি হাসপাতালে যাবে পরিদর্শক দল
• বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে নতুন বিধি
• লাইসেন্স পেতে ফায়ার সার্টিফিকেট দেখানো বাধ্যতামূলক
• প্রতি জেলায় নার্সিং হোম ইউনিট |
দমকল |
• ফায়ার সেফটি অডিট কমিটি গঠন
• ছাড়পত্র দেওয়া আউটসোর্সিং করা হবে
• অগ্নি সুরক্ষার কাজে বেসরকারি সংস্থার সাহায্য |
পুরসভা |
• ঢাকুরিয়া আমরির বেসমেন্টের বেআইনি অংশ না
ভাঙা নিয়ে তদন্ত
• লাইসেন্স দেওয়া ও নবীকরণ নিয়ে পুরসভা ও দমকলে সমন্বয়
• আমরির তদন্ত রিপোর্ট দেখে নতুন নিয়মের ভাবনা
• অগ্নিদগ্ধ আমরির ট্রেড লাইসেন্স বাতিল |
|