ঢাকুরিয়া আমরির (এমআরআইয়ের) ঘটনার পরে বিভিন্ন হাসপাতালের বেসমেন্টে এখন ‘অগ্নিশুদ্ধি’র ধুম।
দু’দিন আগেও যে বেসমেন্ট ছিল কার্যত রাসায়নিকের ‘গুদাম ঘর’, রাতারাতি সেখানে শুরু হয়েছে সাফাই অভিযান। সরানো হয়েছে রাসায়নিক। আবার উল্টো চিত্রও রয়েছে শহরের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে। এত বড় ঘটনার পরেও হেলদোল নেই অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সেখানকার বেসমেন্টে রাসায়নিক আগের মতোই ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে।
হাজার অনুরোধেও শুক্রবার যে হাসপাতালের বেসমেন্টে ঢোকার অনুমতি মেলেনি, শনিবার সেই ক্যালকাটা মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিএমআরআই)-এর কর্তারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বেসমেন্টে নিয়ে গিয়েছেন সাংবাদিকদের। সিএমআরআই-এর বেসমেন্ট যে সম্পূর্ণ ভাবে দাহ্য পদার্থমুক্ত একটি নিরাপদ স্থান, তা প্রতিষ্ঠা করতে কর্তৃপক্ষের ‘তৎপরতা’য় হাসপাতালের কর্মীরাও কিছুটা বিস্মিত। এক কর্মীই বলছেন, “শুক্রবার তো সাংবাদিকদের বেসমেন্টে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। অথচ শনিবার আলোকচিত্রী-সহ সাংবাদিকদের বেসমেন্ট ঘুরে দেখাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ থেকেই মনে হয়, শুক্রবার পর্যন্ত বেসমেন্টে এমন কিছু ছিল, যা মোটেই নিরাপদ নয়।” শনিবার অবশ্য সেখানে তেমন ‘আপত্তিকর’ জিনিস দেখা যায়নি। তবে এএমআরআইয়ের ঘটনার রেশ কাটলেই যে এই সাফাই অভিযান থিতিয়ে পড়ে রাসায়নিকগুলি পুরনো জায়গায় ফিরে আসবে, তা-ও উল্লেখ করতে ভোলেননি ওই কর্মী।
এএমআরআইয়ের ঘটনার পরে নিরাপত্তা জোরদার করতে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিএমআরআই কর্তৃপক্ষ। ওই হাসপাতালের ‘ফায়ার অফিসার’ ভাস্কর চক্রবর্তী বলেছেন, “রাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় টহলদারি শুরু হয়েছে শুক্রবার থেকে। আগে তা দু’ঘণ্টা অন্তর হত। এসি এবং জেনারেটর রুমের উপরে নজর রাখা হচ্ছে।” এ সব সত্ত্বেও কিন্তু শহরের সব থেকে পুরনো এই বেসরকারি হাসপাতালে আগুন নেভানোর জন্য প্রশিক্ষিত এক জন কর্মীও নেই। তাই হাসপাতালের ভরসা নিরাপত্তাকর্মীরাই। তাঁদেরই প্রশিক্ষণ দিয়েই এত দিন কাজ চালানো হচ্ছে বলে ভাস্করবাবু জানান। মাসখানেকেরও আগে দমকলের পক্ষ থেকে পরিদর্শনে এসে নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সব ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয়, এত দিন তা নিয়ে মাথা না ঘামালেও এখন তড়িঘড়ি সেগুলি সেরে ফেলতে চাইছেন কর্তৃপক্ষ। |
শনিবার সল্টলেক আমরির বেসমেন্ট থেকে সরানো হচ্ছে জিনিস। অর্কপ্রভ ঘোষের তোলা ছবি। |
মুকুন্দপুরে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল ‘মেডিকা’। ওই হাসপাতালের চেয়ারম্যান অলোক রায়ের দাবি, তাঁদের হাসপাতালের মতো জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কলকাতা কেন, দেশের কোথাও নেই। কিন্তু শনিবার বিকেলে দেখা গেল, হাসপাতালের পিছন দিকে কর্মীদের প্রবেশপথের সামনে পড়ে রয়েছে কয়েক ডজন নতুন কেনা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। যন্ত্রগুলো কখন এল? এর জবাবে এক কর্মী বলেন, “আজ দুপুরে। অনেকক্ষণ আগেই এগুলো ভিতরে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।”
প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের অরবিন্দ সেবা কেন্দ্রের (ইইডিএফ) একতলায় ক্যান্টিন লাগোয়া যে ঘরে শুক্রবার দুপুরেও সারি সারি অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা ছিল, শনিবার দুপুরে সেখানকার চিত্রটা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে। একটিও অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই সেখানে। ইইডিএফ-এর প্রশাসনিক আধিকারিক সোমশ্রী রায়ের অবশ্য দাবি, আগের দিনের অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলি ফাঁকা ছিল। সেখান থেকে আগুন লাগার কোনও আশঙ্কা ছিল না।
যে হাসপাতালে আগুন লেগে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই এএমআরআইয়ের সল্টলেকের হাসপাতালের বেসমেন্ট থেকে শুক্রবার রাতেই স্পিরিট-সহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ‘সরানো
হয়েছে’ বলে অভিযোগ। হাসপাতাল সূত্রের খবর, বেসমেন্টে আগে রাসায়নিক ডাঁই করা থাকলেও ঢাকুরিয়ার ঘটনার পরে সেগুলিকে আর সেখানে রাখা ‘নিরাপদ’ মনে করেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই রাতারাতি সে সব সরিয়ে ফেলে ‘সাফ’ করা হয়েছে বেসমেন্ট। যদিও কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
কলম্বিয়া-এশিয়া হাসপাতালের বেসমেন্টে জল ছেটানোর জন্য ‘স্প্রিঙ্কলার’ বসানো থাকলেও সেখানে আবার জেনারেটর রুম, হাউস কিপিং-সহ বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি, বেসমেন্ট সুরক্ষিত। প্রতি মাসেই হাসপাতালে আগুন নেভানোর জন্য ‘মক টেস্ট’ হয় বলেও তাঁদের দাবি। হাসপাতালের আধিকারিক অরিন্দম ভট্টাচার্য বলেন, “জেনারেটর রুম থাকলেও তার উপরে তো স্প্রিঙ্কলার রয়েছে। সেইসঙ্গে জল তোলার বিশেষ ধরনের পাম্পও আছে। কোনও ঘটনা ঘটলেই ওইসব যন্ত্রপাতি স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ চালু করবে।”
এই ‘হঠাৎ তৎপরতা’র উল্টো উদাহরণও আছে। যেমন, এএমআরআইয়ের মুকুন্দপুরের হাসপাতাল। সেখানকার বেসমেন্টে এখনও পড়ে রয়েছে ডায়ালিসিস করার তরল। তার পাশেই স্টোররুমে রয়েছে কাগজ। একপাশে বোঝাই করা কাঠ। এ ছাড়া স্থায়ী ভাবে সেখানে আছে এসি-র যন্ত্র, পাম্প রুম, মর্গ, জীবাণুমুক্ত করার দফতর। এগুলির বৈদ্যুতিক তার, রাসায়নিক থেকে তো দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে! সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্মাল্য দেবমান্নার দাবি, এমন কোনও আশঙ্কা নেই।
সল্টলেক করুণাময়ীর আনন্দলোক হাসপাতালের আউটডোর বিভাগটাই চলে বেসমেন্টে। সরকারি নির্দেশ এলে তবেই তা অন্যত্র সরানো হবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন কর্ণধার ডি কে শরাফ। গত দু’বছর ধরে ব্যবহার না হওয়ায় হাসপাতালের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার অনেক জায়গায় যে ত্রুটি দেখা দিয়েছে, তা-ও স্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “শুক্রবার থেকে আবার সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করা হচ্ছে।”
অনেকটা একই রকম অবস্থা আইএলএস হাসপাতালের। এ দিন সন্ধ্যাতেও সেখানকার বেসমেন্ট ভরে ছিল অক্সিজেনের সিলিন্ডার-সহ বিভিন্ন জিনিসপত্রে। জীবাণুমুক্ত করার বিভাগ এবং মর্গও রয়েছে বেসমেন্টে। আধিকারিক সুবীরশঙ্কর কোলে অবশ্য জানিয়েছেন, সরকার নির্দেশ দিলে তাঁরা বেসমেন্ট খালি করে দেবেন। তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলেও ওই হাসপাতালের জানলা খোলা যায়। |