কাচ এত শক্ত হতে পারে, ধারণাই ছিল না।
স্যালাইন ঝোলানোর স্ট্যান্ড তুলে দড়াম দড়াম করে মারছি, কিছুতেই ভাঙছে না। এক-এক মুহূর্ত যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, আর বুঝি হল না!
দু’মিনিট আগেই হাত থেকে স্যালাইনের সূচ খুলেছি। থরথর করে হাত কাঁপছে। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার মানে তো সাক্ষাৎ মৃত্যু!
নিকষ অন্ধকারে ধোঁয়ার গন্ধে ঘুম ভেঙেছিল। বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। চিৎকার, আর্তনাদ। কাচের জানলা দিয়ে বাইরের আলো আসছিল মৃদু। তাতে সব ছায়া ছায়া।
‘সিস্টার, কী হয়েছে?’
‘বিল্ডিং মে আগ লাগি হ্যায়। বাঁচনা চাহতে তো ভাগো’ অন্ধকার থেকে ছিটকে আসে সিস্টারের গলা।
আগের রাতে (বুধবার) হৃদযন্ত্রে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হয়েছে। পাঁচতলায় ‘ইনটেনসিভ থেরাপি ইউনিট’-এ ভর্তি। একটু আগেই বুকে ভাল ব্যথা হচ্ছিল। সিস্টারের কাছে ওষুধও চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে সব ভাবার সময় নয়। পালানোর চেষ্টা করতে হবে। সিঁড়ি কোথায়? ধোঁয়ায়-অন্ধকারে ঠাহর করবে কে? এক মাত্র উপায় কাচের ইমারজেন্সি গেট ভেঙে নীচে নামার চেষ্টা করা।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় মাথার কাছে মনিটর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক সিস্টার দ্রুত খুলে দেন গায়ে লাগিয়ে রাখা নানা তার, স্যালাইনের সূচ। হাতে তুলে নিই স্যালাইনের স্ট্যান্ড। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েক জন রোগী। মারো, মারো
হঠাৎই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে কাচ। এক ঝলক তাজা হাওয়া!
ছিটকে বেরিয়ে আসি বাইরের বারান্দায়। পিছনে আরও আট-দশ জন রোগী, তাঁদের কারও কারও মুখে তখনও অক্সিজেনের মাস্ক। আর দুই সিস্টার। পাশের বস্তির যুবকেরা তত ক্ষণে দেওয়ালে মই লাগিয়ে তিনতলা পর্যন্ত উঠে এসেছেন। আমাদের বেরোতে
দেখেই ওঁরা চিৎকার করেন, ‘দড়ি বেয়ে নীচে নামতে পারবেন?’ |
এ ভাবেই নেমেছিলাম। দেখাচ্ছেন বিকাশ দে। সল্টলেক আমরি-তে সুদীপ আচার্যের ছবি। |
মাথা কাজ করছিল না। দুর্বল হৃদপিণ্ড ধকল নিতে পারবে? দড়ি ধরে নামতে গিয়ে খসে পড়ে যাবে না তো আটচল্লিশ বছরের অসুস্থ শরীরটা? কিন্তু... হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে ওঠে টিভিতে দেখা স্টিফেন কোর্টের সেই দৃশ্য। লাফিয়ে ওঠা আগুনের শিখা থেকে বাঁচতে দড়ি বেয়ে নামার মরিয়া চেষ্টা করছে কয়েক জন। চেঁচিয়ে বলি, ‘দড়ি দিন। পারব।’
কিন্তু মোটা পাটের দড়ি দু’তলা উপরে আসবে কী করে? কয়েক জন ভিতরে ঢুকে নিয়ে আসি অনেকগুলো বিছানার চাদর। সেগুলোই পরপর বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। তার প্রান্তে দড়ি বেঁধে দেন নীচের লোকেরা। আমরা টেনে উপরে তুলে নিই। তার পরে শক্ত করে দড়ি বেঁধে ফেলি বারান্দার রেলিংয়ে। এ বার?
পাঁচতলা থেকে নীচে তাকিয়ে সকলেরই পা কাঁপছে। শুকিয়ে আসছে গলা। কে যাবে প্রথমে? কয়েক মুহূর্তের দোলাচল। তার পরেই চেপে ধরি দড়ি। তখন আমি ধরেই নিয়েছি, মরে যাব। শেষ চেষ্টা করতে দোষ কী? রেলিং টপকে প্রথম পা রাখি
বারান্দার প্রান্তে, তার পর দেওয়ালে।
বুকের মধ্যে দড়াম দড়াম করছে। হাত পিছলে যাবে না তো?
আপ্রাণ চেপে ধরি দড়িটা। হাতে অসম্ভব লাগছে। এক পা, দু’পা, তিন পা, চার পা নামছি, নামতেই হবে। উপরে মরণাপন্ন কয়েকটি মানুষ, নীচে রুদ্ধশ্বাস জনতা। পা ফস্কে যাচ্ছে মাঝে-মাঝেই। ঘষটে যাচ্ছে দেওয়ালে। একটু ভারসাম্য হারালেই সব শেষ! চারতলা পেরোলাম কি? কোনও দিকে তাকাতে পারছি না। চোখের সামনে শুধু
দড়ি। পায়ের সামনে শুধু দেওয়াল।
তিনতলা পেরোনোর সময়ে মইয়ে ওঠা ছেলেদের চিৎকার ‘হয়ে যাবে দাদা, হয়ে যাবে। ঠিক পারবেন।’
পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক একতলা! পায়ের নীচে মাটি! ভাবতেই পারছি না! দু’হাতের ছালচামড়া সব উঠে রক্তে মাখামাখি। কিন্তু কিছু যেন মনেই হচ্ছে না। পা, বুক, হাঁটু কেটে-ছড়ে একসা। কে ভাবছে সে সব! যেন এক্ষুনি ফের জন্মালাম পৃথিবীতে!
আর কিছু মনে নেই স্পষ্ট।
শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। আমরি অ্যানেক্স-১ থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসা আরও অনেকের মতো আমাকেও নিয়ে যাওয়া হল অন্যত্র। শনিবার সকালে সেখান থেকে সল্টলেক আমরি-র আটতলায়, ৭৭ নম্বর বেডে।
জলপাইগুড়িতে আমার মেয়ে-বউ অবশ্য এখনও কিছুই জানে না। বিদ্যুৎ দফতরের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুবাদে আমার কর্মস্থল আপাতত নদিয়ার দেবগ্রামে। বুধবার অফিসেই বুকে ব্যথা। ডাক্তার দেখে বললেন, হার্ট অ্যাটাক। দুই ভাই আর মাকে খবর দিয়ে সহকর্মীরা আমরি-তে ভর্তি করেছিলেন।
আমার ছেলে অন্য রাজ্যে চাকরি করে। মেয়ে বি-টেক পড়ে শিলিগুড়িতে, থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। আমার অসুস্থতার খবর পেলে ওরা সব শিকেয় তুলে
কলকাতায় ছুটে আসবে। তাই আমিই ওদের বলতে বারণ করেছিলাম।
কিন্তু এখন ওদের দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। |