বহুতল বাড়ির উঁচু তলায় থাকার আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে শ্রীপদ আচার্যকে। সেই আতঙ্কে হাসপাতালেও আর থাকতে পারছেন না তিনি। এ জন্য শনিবার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।
আগরতলার বাসিন্দা শ্রীপদবাবু ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের পাঁচ তলায়। অগ্নিকাণ্ডের পরে শুক্রবার সকালে যখন তাঁকে সল্টলেকের আমরি-তে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁর জন্য বরাদ্দ করা হয় সাত তলার একটি ঘর! শ্রীপদবাবুর আতঙ্ক, “উঁচুতে থাকলে নেমে আসার কী ঝুঁকি, তা ওই রাতেই টের পেয়েছি। আমার স্ত্রী অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কিন্তু বার বার তো তেমন না-ও ঘটতে পারে।”
বৃহস্পতিবার রাতে শ্রীপদবাবুর স্ত্রী মুন্নাদেবী আগুন লেগেছে বুঝে পাঁচ তলায় উঠে কোনও মতে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে এনেছিলেন তাঁর স্বামীকে। ভয়ঙ্কর সেই আগুনের দুঃস্বপ্ন শুক্রবার রাতেও তাড়া করে বেড়িয়েছে শ্রীপদবাবুকে। তাঁর কথায়, “আর হাসপাতালের উঁচু তলায় ভর্তি থেকে চিকিৎসার সাহস হল না। আপাতত আগরতলা ফেরার টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছি।” শ্রীপদবাবু আপাতত রয়েছেন সল্টলেকের ত্রিপুরা ভবনে। বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সপ্তাহ খানেক আগে ঢাকুরিয়ার ওই হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এখনও তাঁরা সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। মাথায় জমাট বেঁধে রয়েছে রক্ত।
এই আতঙ্কেরই নানা রকম ছবি এ দিন দেখা গেল ঢাকুরিয়ার হাসপাতাল চত্বরে। যে ২৪ জন রোগী এখনও ভর্তি , রাতটা তাঁরা কাটিয়েছেন চরম আতঙ্কের মধ্যেই। একই অবস্থা হয়েছিল তাঁদের পরিজনদেরও। এ দিন সকাল হতে না হতেই আত্মীয়রা ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। এমনই এক রোগীর আত্মীয়ের কথায়, “অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে প্রচুর টাকা জমা আছে। এখন রোগীকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলে সেই টাকা হয়তো ফেরত পাব না। তাই এখানেই রাখতে হয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালের প্রতি আর আমাদের কোনও ভরসা নেই। প্রতি মুহূর্তে দুর্ঘটনার ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে।” |
আঘাত দেখাচ্ছেন শ্রীপদ আচার্য। ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ |
শুক্রবার সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি নুরউন্নেসা বিবি। কখনও তাঁর মনে হয়েছে ধোঁয়ার তীব্র, কটু গন্ধ পাচ্ছেন, কখনও মনে হয়ছে দম আটকে আসছে। আগের রাতের ভয়াবহ আগুন থেকে কোনও মতে রক্ষা পেয়েছিলেন এই প্রৌঢ়া। এ দিনও রাত যত বেড়েছে, সেই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়িয়েছে তাঁকে। প্রায় ফাঁকা ওয়ার্ডে আক্ষরিক অর্থেই ভয়ে কেঁপেছেন তিনি।
কী ভাবে বাঁচলেন নুরউন্নেসা? জানালেন, শুক্রবার রাতে গোটা ওয়ার্ডে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তখন সাহস না হারিয়ে নিজেই স্যালাইনের স্ট্যান্ডটা তুলে ওয়ার্ডের জানলার কাচ ভাঙেন তিনি। তার পর? শনিবার দুপুরে ওয়ার্ডের শয্যায় শুয়ে প্রৌঢ়া বললেন, “তীব্র গন্ধে চোখ জ্বালা করছিল। শ্বাস নিতে পারছিলাম না। জানলা ভেঙে কোনও মতে মুখ বাড়াতেই দমকল কর্মীরা ভিতরে জল দিতে শুরু করলেন। চোখেমুখে সেই জল যাওয়ার পরে একটু ধাতস্থ হলাম। তার পরে দমকলের লোকেরাই কোমরে দড়ি লাগিয়ে নীচে নামালেন।”
আতঙ্কের মধ্যেও অনাত্মীয় মানুষের যে মানবিক মুখ বৃহস্পতিবার দেখেছেন, তাকে সারা জীবনের সম্পদ বলে মনে করছেন ৮৭ বছরের বৃদ্ধা অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। প্রবল ধোঁয়ায় দম আটকে তিনি যখন হাঁসফাঁস করছেন, তখন কাঁচ ভেঙে ওই ওয়ার্ডে পৌঁছেছিলেন দুই যুবক। চার তলার ওয়ার্ড থেকে তাঁরাই বের করেছিলেন অশীতিপর ওই বৃদ্ধাকে। ওই মৃত্যু-নিকেতন থেকে রক্ষা করে যাঁরা তাঁকে আক্ষরিক অর্থেই নতুন জীবন দিলেন, তাঁদের আর এক বার দেখতে চান অপর্ণাদেবী। দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করে যেতে চান। শুক্রবার মৃতের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশ করে দিয়েছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে ভুল স্বীকার করা হয়। এ দিন অবশ্য ঝুঁকি নিতে চাননি তাঁর পরিবারের লোকেরা। মেয়ে ব্রততী গঙ্গোপাধ্যায় সকালে এসে তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যান।
ব্রেন টিউমার অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৯ বছরের গীতিকা সিংহ হরিজান। কোচবিহারের এই মেয়েটির অস্ত্রোপচার আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল সে। এ দিন তাকেও বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান তার বাবা-মা। বললেন, “কোনও ক্রমে কালকের রাতটা কাটিয়েছি। আর নয়।”
হাসপাতালের মেডিক্যাল সুপার সুমন ঘোষের দাবি, যাঁরা এখনও হাসপাতালে ভর্তি, তাঁদের চিকিৎসার ত্রুটি হচ্ছে না। তবে পরিকাঠামোগত সমস্যার জন্য হৃদরোগীদের অন্যত্র যাওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।
শুক্রবার ঢাকুরিয়ার ওই হাসপাতাল থেকে ৫৮ জনকে মুকুন্দপুরে ওই গোষ্ঠীর আরেকটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁদের অনেককেই এ দিন ছেড়ে দেওয়া হয়। ঢাকুরিয়ার হাসপাতালের নার্স কাজল দাসদত্তের বৃহস্পতিবার প্রসব হয়েছিল ওই হাসপাতালেই। তিনি সন্তান-সহ মুকুন্দপুরে ভর্তি। কিন্তু আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে কাজলকে। বললেন, “রাত আড়াইটে নাগাদ আগুন লাগার খবর পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। বাচ্চাটা নার্সারিতে ছিল। প্রথমেই ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। বরাতজোরে বেঁচে গিয়েছি। সকালে নিজেই বাড়িতে ফোন করে সুস্থ থাকার খবরটা জানাই।”
রুবি জেনারেল হাসপাতালে যে ছ’জন শুক্রবার আমরি থেকে ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক জন এ দিন বাড়ি ফিরে গেছেন। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মাইকেল আর্থার ডমিঙ্গো নামে এক ক্যানসার রোগী সেই রাতে সিঁড়ি দিয়ে কোনও মতে নীচে নামতে পেরেছিলেন। রুবি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি বললেন, “ভগবানই জানেন, কী ভাবে নামতে পেরেছিলাম!” |