বাবা লোকাল ট্রেনে বাদাম ফেরি করেন। সংসার চলে খুঁড়িয়ে। মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে পঞ্চাননতলা বস্তির আট বাই দশ ফুটের টালির চালের একটা কামরা। শনিবার সেই ঘরের সামনেই ভিড় করেছেন এলাকার লোকজন। এই বাড়ির তেইশ বছরের ছেলেটিই আজ তাঁদের চোখে ‘নায়ক’।
সাউথ সিটি কলেজের সান্ধ্য বিভাগের বি কম অনার্সের ছাত্র শঙ্কর মাইতি বৃহস্পতিবার রাতে বাজি রেখেছিলেন নিজের জীবনকে। অনেকগুলো প্রাণ বাঁচিয়ে শঙ্কর নিজেই এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হাজরা এলাকার একটি হাসপাতালে।
গভীর রাতে এএমআরআই হাসপাতালে আগুন লাগার পরে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে শঙ্কর ঢুকে পড়েছিলেন ভিতরে। হাসপাতালের বিছানার সবুজ চাদরগুলোকে স্ট্রেচারের মতো ব্যবহার করে হাতে হাতে তাঁরা নামিয়ে এনেছিলেন অনেককেই। এলাকার যুবকেরা জানান, দমবন্ধ করা কালো ধোঁয়ায় প্রায় আট ঘণ্টা ধরে উদ্ধারকাজ চালিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন শঙ্কর। দুপুর থেকে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। রাতেই তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালের আইসিইউতে।
তিন ভাইবোনের মধ্যে শঙ্করই ছোট। বাবা শশধর বাদাম বেচে অতি কষ্টে সংসার চালান। কোনও রকমে বড় মেয়ে
|
শঙ্কর মাইতি |
দুর্গার বিয়ে দিয়েছেন। ভাই হাসপাতালে ভর্তি জেনে দিদি পত্রপাঠ চলে এসেছেন বাপের বাড়িতে।
শঙ্করদের ঘরের সামনে তিন ফুট উঁচু ইটের গাঁথনি দেওয়া ছোট একটা জায়গা। সেটাই ঘরের বারান্দা। সেখানেই রান্না হয়। রান্নাঘরের সামনেই পুরসভার কংক্রিটের রাস্তা। মাঝখানে নর্দমার বড় ঝাঁঝরি। সামনের ঘর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার এনে রাস্তায় বসিয়ে দিলেন শঙ্করের আর এক দিদি সরস্বতী। বললেন, “খুব ছোট ঘর আমাদের। কিছু মনে করবেন না।” পাড়ার ছেলেরা জানালেন, শঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জেনে পাড়ার লোকজন তো বটেই, পাশের পাড়া থেকেও অনেকে খোঁজ নিতে আসছেন।
কলেজছাত্রী সরস্বতী জানালেন, তাঁদের বাবা ও মা শুক্রবার রাত থেকে হাসপাতালে রয়েছেন। পাড়ারও অনেকে রয়েছেন সেখানে। কিন্তু ভাইয়ের চিকিৎসার খরচ কী ভাবে জোগাড় হবে, সেটাই তাঁরা ভেবে পাচ্ছেন না। দুর্গা বলছিলেন, শঙ্কর আর তাঁর বন্ধুরা বরাবরই পরোপকারী। কেউ বিপদে-আপদে পড়লে ছুটে যান। এ বারেও হাসপাতালের রোগীদের ওই অবস্থায় দেখে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি তাঁরা। প্রাণ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে একে একে বার করে এনেছেন বহু রোগীকে।
শঙ্করের পাড়ার বন্ধু বিশ্বজিৎ কয়াল, দীপপ্রকাশ কয়াল, রঞ্জিত সর্দাররা জানালেন, হাসপাতালের যে অংশে আগুন লেগেছিল, ঠিক তার পিছনেই শঙ্করের ঘর। হাসপাতালের জানলায় জোরে জোরে ধাক্কা মারার আওয়াজ, রোগী-নার্সদের আর্তনাদে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পঞ্চাননতলা বস্তির। বাসিন্দারা প্রথমে ভেবেছিলেন, কোনও রোগীর মৃত্যুর জেরে তাঁর বাড়ির লোকজন হয়তো হাসপাতালে ভাঙচুর চালাচ্ছে। কিন্তু বস্তির কয়েক জন মহিলা রাস্তার আলোয় দেখতে পান হাসপাতালের ভিতর থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। তখনই ছুটে যান সকলে।
পঞ্চাননতলা বস্তির অনেক যুবকই স্নাতক। কেউ সামান্য রোজগার করেন, কেউ করেন না। যাঁরা রোগীদের বাঁচাতে গিয়েছিলেন তাঁদের অভিযোগ, এলাকার লোক জেনেও ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের চিকিৎসার কোনও সুবিধা দেননি। বরং এমনও হয়েছে, বস্তির কেউ হাসপাতালে ছোটখাটো চিকিৎসার জন্য গেলে বলা হয়েছে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যে গরিবদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত রাখা উচিত, সে কথাও বলছিলেন তাঁরা।
প্রাণের মায়া না করে সেই হাসপাতালেই উদ্ধারকাজে ঝাঁপালেন কেন? দীপপ্রকাশের মতো যুবকরা বলছেন,“রোগীরা একে তো ঘটিবাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করাচ্ছেন, তার ওপরে যদি প্রাণটাই চলে যায়! তাই ছুটে গিয়েছিলাম। ওই কাজ করতে গিয়েই অসুস্থ হয়ে পড়ল শঙ্কর। অথচ দেখুন, কেউ তার খোঁজই নিল না।” |