হাট-বাজার থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। বাস-ট্রেনের নিত্য যাত্রী থেকে আদালতের বাইরে জড়ো-হওয়া জনতা। সর্বত্র তাঁর মুণ্ডপাত হচ্ছে। উঠছে কঠোরতম শাস্তির দাবি। এই বিপুল জনরোষের মুখে দাঁড়িয়েও তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগানোর শেষ চেষ্টা চালিয়েছিলেন শ্রবণ কুমার তোদি। শেষ পর্যন্ত পারেননি। কারণ, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
ঢাকুরিয়ার হাসপাতালে শুক্রবারের মর্মান্তিক ঘটনার পরেই আমরি-র অন্যতম কর্ণধার তোদি বুঝতে পেরেছিলেন, প্রশাসনিক ফাঁস তাঁদের উপরে চেপে বসতে চলেছে। তবু একটি সূত্রের মাধ্যমে তাঁরা চেষ্টা চালিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতার কাছে ‘বার্তা’ পৌঁছনোর। কিন্তু তোদিরা যে সূত্রটিকে ‘মাধ্যম’ হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ‘বার্তা’ দেনইনি! কারণ, তার আগেই আমরি-র অকুস্থলে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, হাসপাতাল মালিকদের গ্রেফতার করা হবে। তাতে যেমন এক দিকে জনতার ক্ষোভের বাষ্প কিছুটা হলেও বার করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, তেমনই সংশ্লিষ্ট মহলের কাছেও প্রয়োজনীয় ‘বার্তা’ চলে গিয়েছিল।
অগত্যা শুক্রবার বিকালেই লালবাজারে ছুটতে হয়েছে তোদীদের।
এ রাজ্যে তোদিদের বরাবরের পরিচয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং আরও স্পষ্ট ভাবে প্রয়াত জ্যোতি বসুর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবে। রাজনৈতিক প্রভাবই যাঁদের ব্যবসায়িক প্রতিপত্তির প্রধানতম ভিত্তি, জীবনের ‘কঠিনতম’ মুহূর্তে আরও একটি ‘কঠোর বাস্তবে’র সাক্ষী থাকতে হয়েছে তাঁদের! যে সিপিএমের দৌলতে তোদিদের চোখ ধাঁধানো উত্থান, যে দলের সদস্যপদ পর্যন্ত পেয়েছেন শ্রবণ, সেই আলিমুদ্দিনই নজিরবিহীন ট্র্যাজেডির দিনে তাঁদের পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁর প্রশাসনকে কড়া হতে নির্দেশ তো দিয়েছেনই। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও বিবৃতি দিয়ে ‘দোষীদের যথোচিত শাস্তি’ দাবি করেছেন। বিমানবাবুর সঙ্গেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এস কে তোদির ‘সম্পর্ক’ খারাপ ছিল না। কিন্তু এমন ভয়াবহ ঘটনার পরে ব্যক্তিগত বা দলীয় সম্পর্ক আর তোদীদের কাজে আসেনি। রাজনৈতিক শিবিরের একটি অংশের মতে, এখন বিরোধী দল হওয়ার সুবাদেই তোদিদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা সহজ হয়েছে আলিমুদ্দিনের পক্ষে। কারণ, শাসক দল হলে যে প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকে, স্বাভাবিক কারণেই বিরোধী দল সেই পর্যায়ে পড়ে না।
তবু আমরি-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ‘অস্বস্তিকর’ প্রশ্ন সামলাতে হচ্ছে সিপিএমকে। আলিমুদ্দিনের ‘ভরসা’ মাথার উপরে থাকার জন্যই তোদিদের হাসপাতাল নানা বেনিয়ম করেও পার পেয়ে গিয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন প্রবল ভাবে উঠছে। একটু অতীত ঘাঁটলেই দেখা যাবে, সিপিএমের সঙ্গে তোদীদের সম্পর্ক কতটা ‘গভীর’ ছিল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর শেষ বয়সের চিকিৎসা হয়েছিল আমরি-রই ঢাকুরিয়া এবং সল্টলেকের হাসপাতালে। বসুর মৃত্যুও হয়েছিল সল্টলেকের হাসপাতালেই। আমৃত্যু এই যে সম্পর্ক, তার সূত্রপাত বহু বছর আগে। ছয়ের দশকের শেষ দিকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, ঢাকায় তোদীদের গ্লাস ফ্যাক্টরির সূত্রেই জ্যোতিবাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ। সাতের দশকে দমদমে ওই গোষ্ঠীর একটি কারখানায় সিপিএমের কর্মীরা আশ্রয় নিতেন। অতীতের ‘কঠিন সময়ে’ ওই গোষ্ঠীরই প্রেস সিপিএমের ছাত্র সংগঠনের নথিপত্র তৈরিতে বিস্তর সাহায্য করেছে। পরবর্তী কালে প্রদীপ কুন্দলিয়ার বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনার পরে সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আবাসন তৈরির প্রকল্পে যুক্ত হয় ওই গোষ্ঠী। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “শুধু জ্যোতিবাবুর চিকিৎসা নয়, যে দু’টি বেসরকারি গোষ্ঠীর সঙ্গে সিপিএমের বহু দিনের যোগাযোগ, ওঁরা তার একটি।”
এই যোগাযোগ কাজে লাগিয়েই ১৯৯৬ সালে ঢাকুরিয়ায় আমরি-র হাসপাতালের আত্মপ্রকাশ। ‘নিরাময় পলিক্লিনিক’ সরকারের সঙ্গে চুক্তি মারফত রূপান্তরিত হয়েছিল আমরি হাসপাতালে। ১৯৯৪ সালের ১৭ জুন রাজ্য সরকারের সঙ্গে আমরি কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়। ৩০ বছরের ‘লিজ’ হয়েছিল। সেই সময়ে ১ কোটি ৫ হাজার ২৫ টাকায় যে চুক্তি হয়, তার মধ্যে ৭৮ লক্ষ টাকা ইক্যুইটি শেয়ার হিসাবে রাখা হয়েছিল রাজ্য সরকারের জন্য। গোড়ায় রাজ্য সরকারের বড় অংশীদারী থাকলেও পরবর্তী কালে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় পুরো মালিকানাই বেসরকারি হাতে চলে যায়। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসুই ১৯৯৬ সালে হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন।
পরবর্তী কালে সল্টলেক এবং মুকুন্দপুরে হাসপাতাল-সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়। বাড়তে থাকে বিধি ভাঙার অভিযোগও। খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা, সমাজ-কর্মী দেবপ্রিয় মল্লিকের (যিনি নিজেও আমরি-র ‘ভুল চিকিৎসা’র ভুক্তভোগী) অভিযোগ, সল্টলেকে নগরোন্নয়নের অনুযায়ী একটি প্লটে একটিই বাড়ি হওয়ার কথা। কিন্তু জেসি-১৬ এবং জেসি-১৭ প্লট দু’টি সংযুক্ত করে দিয়ে আমরি কর্তৃপক্ষ সল্টলেকের হাসপাতালের বাড়ি তৈরি করেন। সল্টলেকে ৫ কাঠা বাড়ি করলে ৪৫% ফাঁকা জায়গা রাখার নিয়ম। সেগুলোও রাখা হয়নি। বেআইনি নির্মাণের অভিযোগও আছে। দেবপ্রিয়বাবুর কথায়, “সবই হয়েছে জ্যোতিবাবু এবং প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর আনুকূল্যে।”
আমরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রাজ্য সরকারের চুক্তি অনুযায়ী, সরকারি তরফে কোনও রোগী ভর্তি হলে তাঁর চিকিৎসার খরচে ৪০% পর্যন্ত ছাড় দেওয়া যেতে পারে। বসুর শেষ চিকিৎসার বিলও সেই ভাবেই হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ীই, বর্হিবিভাগ ও অন্তর্বিভাগে নিখরচায় চিকিৎসা করানোর জন্য কিছু ‘কোটা’ রাখার কথা। অভিযোগ, সেই সব ‘শর্ত’ অনায়াসে উপেক্ষিত হয়েছে আলিমুদ্দিনের স্নেহচ্ছায়ায়! বহু মানুষের প্রাণের মূল্যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে সব প্রশ্নই এখন নতুন করে উঠছে। আমরি-কাণ্ডে মৃতদের স্মরণে দলের রাজ্য সদর দফতর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মোমবাতি মিছিলের পরে শনিবারই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ যেমন দাবি করেছেন, “রাজ্যের সব ক’টি আমরির লাইসেন্স বাতিল করা উচিত। তা ছাড়া, আইন না-মানা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য দফতর, দমকল, পুলিশ এবং পুরসভার যাঁরা এত দিন ধরে তাদের ছাড় দিয়েছেন, তাঁদেরও শাস্তি হওয়া দরকার!”
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য, বাম আমলের এক ‘দাপুটে’ মন্ত্রীর কথায়, “তোদিদের সঙ্গে আমাদের দলের সম্পর্ক বহু দিনের। তাতে লুকোছাপারও কিছু নেই!” আমরি-র ঢাকুরিয়া হাসপাতালের পরিচালকমণ্ডলীর এক সময়ের সরকার মনোনীত সদস্য রবীন দেব বলছেন, “উত্তর কলকাতার মেয়ো হাসপাতালের পুনরুজ্জীবনের জন্য জ্যোতিবাবুর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় (অধুনা মন্ত্রী)। তখন বিধায়ক হিসাবে বলেছিলাম, তা হলে ‘নিরাময়ে’র পুনরুজ্জীবন কেন হবে না? তোদিরা এগিয়ে আসেন। রাজ্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের (পিপিপি) ফসল হিসাবে আমরি তৈরি হয়। তা না-হলে ওই ধুঁকতে-থাকা পলিক্লিনিকটি বাঁচত না।” দুর্ঘটনার পরে শুক্রবারও আমরি এবং এসএসকেএমে মৃত, আহতদের পরিবারের ‘পাশে দাঁড়াতে’ গিয়েছিলেন রবীনবাবু। স্থানীয় বিধায়ক হিসাবে যেমন গিয়েছিলেন সরকারি পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর স্ত্রীর বেশ কিছু দিন আগেই ওই হাসপাতাল থেকে ছুটি হয়ে গিয়েছিল।
‘নিরাময়’ বাঁচানোর উদ্যোগ কী ভাবে পরবর্তী কালে নানা সম্প্রসারণ এবং আরও নানা ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত জতুগৃহ হয়ে দাঁড়াল, তার বহু উত্তর এখনও অস্পষ্ট। তবে এটা স্পষ্ট যে, গোড়ায় বসু এবং আলিমুদ্দিনের হাত ধরে তোদিদের যাত্রা শুরু হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বে তাঁদের মহাকরণের আশেপাশে বিশেষ দেখা যায়নি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েক জন সদস্যের তোদি-ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যত ‘চর্চা’ই থেকে থাকুক না কেন!
সত্য এটাও যে, হাসপাতাল-সাম্রাজ্য গড়ে ফেলার পরে আমরি-র প্রতি কোনও বিশেষ ‘দাক্ষিণ্যে’ নীতিগত ভাবে আপত্তি ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের। শেষ চিকিৎসায় বসু যখন আমরি-তে চিকিৎসাধীন, দলের অন্দরে সূর্যবাবুই প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেন বেসরকারি হাসপাতালেই ভর্তি হবেন? তাতে সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যায়। বিরোধী দলনেতা হয়ে সেই সূর্যবাবুই সকালে ছুটে গিয়েছেন দুর্ঘটনাস্থলে, গিয়েছেন এসএসকেএমের মর্গে, কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। এবং যাতে শুধু বিবৃতি না-দিয়ে তিনি পীড়িত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যান, তার জন্য রাজি করিয়েছেন রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুকে। এমনকী, দলীয় সূত্রের খবর, হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যাতে বিমানবাবুর ‘দেখা হয়ে যায়’, তার জন্যও ‘সক্রিয়’ ছিলেন প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তবে ঘটনার পরে ‘দায়’ ঝেড়ে ফেলতে চাইলেই যে ‘দায়মুক্ত’ হওয়া যায় না, সিপিএম নেতৃত্বও তা বিলক্ষণ জানেন। এখন দেখার, আমরি-কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হলে দলের সদস্য এস কে তোদির বিরুদ্ধে দলীয় স্তরে তাঁরা ‘ব্যবস্থা’ নেন কি না! |