একা হাতেই ৮৩টি ময়নাতদন্ত
লাশকাটা ঘরে ৮৩টি মৃতদেহ, ৫৭ বছরের এক চিকিৎসক এবং ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট!
৯ ডিসেম্বর এএমআরআই হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের দিন বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন এসএসকেএম মর্গ চত্বরে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করছেন যে, স্বজনদের সুবিধার্থে কী দ্রুততায় সেরে ফেলা হচ্ছে মৃতদের ময়নাতদন্ত, ঠিক তখন মৃতের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই চিকিৎসক। তাঁর সামনে চারটি টেবিলে এক সঙ্গে চারটি করে মৃতদেহ এনে রাখা হচ্ছে। চার সহকারীকে নিয়ে নাগাড়ে সেই দেহগুলির ময়নাতদন্ত করে চলেছেন তিনি। কনকনে এসির মধ্যেও ঘাম জমছে তাঁর কপালে। দু’হাত ব্যস্ত। তাই ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছেন সহকারী। মাঝেমাঝে একটু জল খাইয়ে দিচ্ছেন। এই ভাবেই কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
শুক্রবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিট থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এ ভাবেই ৮৩ জনের ময়নাতদন্ত করেছেন এসএসকেএমের ফরেন্সিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান বিশ্বনাথ কাহালি। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা কুড়িয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় কাজ শেষ করেছেন তিনি। সারা দিন খাওয়া হয়নি, বিশ্রাম নেননি। ৮৩টি দেহের ময়নাতদন্তের পরে মর্গ থেকে বেরিয়ে রাত একটা পর্যন্ত চুপচাপ একা বসে ছিলেন এসএসকেএম চত্বরে একটি গাছের নীচের শানবাঁধানো বেদিতে। বসে বসে নিজেই নিজেকে আরও এক বার বুঝিয়েছেন নিজের দর্শন “জীবন হল প্রশ্নপত্রের মতো। যতক্ষণ পরীক্ষা হচ্ছে না তত ক্ষণ তা নিয়ে কত কৌতূহল, জল্পনা। আর যেই পরীক্ষা হয়ে গেল, তখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যা কিছু জটিল ছিল সবই তখন সরল, সব শেষ।”
বিশ্বনাথ কাহালি
নিজেকে না-বুঝিয়ে উপায় ছিল না। সার সার রোগীর মৃতদেহের সামনে এত দিনের পোড় খাওয়া ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকের ভিতরটাও কোথায় যেন টাল খেয়ে গিয়েছিল। শনিবার নিজের অফিসের ঘরে বসে বার বার আনমনা হয়ে যেতে যেতে বলছিলেন, “এঁরা তো সবাই রোগী। হাতে-পায়ে প্লাস্টার, স্যালাইনের নল লাগানো। হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বের হওয়ার। পারেননি। দু’টি নার্সের দেহ এল। ইউনিফর্ম পরা। একদম বাচ্চা মেয়ে। একটা কষ্ট গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠছিল।”
তার পরেও কী করে ছুরি-কাঁচি হাতে সেই দেহগুলোর ময়নাতদন্ত করতে পারলেন? একটা নয়, দু’টো নয়, পর পর ৮৩টা! চিকিৎসকের চোয়াল শক্ত হল, “কাজ তো কাজই। এটা আমার পেশা, এটা দায়িত্ব। ছাত্র থাকাকালীন আমাদের ‘মাস ডিজাস্টার’ কী ভাবে সামলাতে হবে তা শেখানো হত। তার উপর এখন তো মৃতদেহ ঘেঁটে ঘেঁটে বুড়ো হয়ে গিয়েছি। বেশিক্ষণ আবেগটাবেগ থাকে না। চট করে মন শক্ত করতে পারি। মৃত্যু আর সে ভাবে স্পর্শ করে না। মৃতদেহ এখন একটা অবজেক্ট।” তবে এ বারের চ্যালেঞ্জটা ছিল অন্য রকম। ১৯৮৮ সালে তিনি যখন ব্যারাকপুর মর্গে, তখন উত্তর ২৪ পরগনায় দু’টি বাস একসঙ্গে নয়ানজুলিতে পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় এক দিনে ১৩০টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেছিলেন বিশ্বনাথবাবু। জ্ঞানেশ্বরীর দুর্ঘটনা, স্টিফেন কোর্ট বা কাকদ্বীপের নৌকাডুবির সময়েও একসঙ্গে অনেক ময়নাতদন্ত করতে হয়েছে। তা-ও আমরির অভিজ্ঞতাকে একেবারে আলাদা ভাবে দেখছেন। তাঁর কথায়, “মর্নিংওয়াক করছিলাম। তখন সওয়া ছ’টা হবে। সোজা মর্গে আসতে হল। পরপর মৃতদেহ আসতে লাগল। সবচেয়ে অবাক হলাম, কোনও মৃতদেহে কোনও বিকৃতি নেই দেখে। মনে হচ্ছে, যেন হাসপাতালের শয্যায় ঘুমোচ্ছেন সবাই। সব দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু। শুধু গুড়ো কার্বনে চোখমুখ কালো হয়ে ছিল।”
কিন্তু মাত্র ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ৮৩টি দেহের ময়নাতদন্ত করা কতটা সহজ? কাঁটাপুকুর মর্গের চিকিৎসক উমাপ্রসন্ন ঘোষাল বা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিনের শুদ্ধোদন বটব্যালের মতে, এত কম সময়ে এতগুলি ময়নাতদন্ত করা ভীষণ কঠিন। এতে কাজের প্রতি সুবিচার সব সময় করা যায় না। তবে জরুরি অবস্থায় তো অত রুল-বুক অনুযায়ী কাজ হয় না। সম্ভব নয়। বিশ্বনাথবাবুর বিশ্বাস, “কাজের সময় কিছু মাথায় থাকে না। কালকেও থাকেনি। একটু হাত ব্যথা, মাথা ঝিমঝিম করছিল, কিন্তু ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সময় কী ভাবে কেটেছে জানি না। রাত ২টোয় বাড়ি ফিরে দু’বার স্নান করে ফ্রেশ হয়ে গিয়েছিলাম।” একটা রাত পার হয়েছে। ৮৩ মৃতদেহের ঘোর কাটিয়ে নতুন দিন শুরু করে ফেলেছেন বিশ্বনাথবাবু। মৃতদেহ নিয়ে দিন কাটিয়েও মৃত্যুকে ছুঁয়ে থাকতে চান না তিনি। যাঁর দর্শন “মৃত্যু অনিবার্য। তবু লাইফ ইজ বিউটিফুল।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.