খাতায়-কলমে সুরক্ষার আইন থাকাই সার। সেই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রশাসনের চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে ঢাকুরিয়ার আমরি চলছিল তার নিজের নিয়মে।
অন্তত ৯১ জন অসহায় রোগীর প্রাণের বিনিময়ে এ বার সেটাই চোখে পড়ল গোটা রাজ্য তথা দেশের। এ দেশের বহুতলগুলির সুরক্ষার নিয়ম যাঁরা ঠিক করেন, তাঁরাও বেসরকারি হাসপাতালটির ‘লাগামছাড়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’য় হতবাক। জাতীয় বহুতল সুরক্ষা বিধি বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (এনবিসি)-এর নির্ণায়ক কমিটির আহ্বায়ক সতীশকুমার ভেরি শনিবার বললেন, “দেশের অনেক বহুতলে সুরক্ষার নিয়ম মানায় ফাঁক থাকে ঠিকই, কিন্তু কলকাতার আমরি হাসপাতালে যা দেখা গিয়েছে, তা অভাবনীয়। রোগীদের বের করার ঠিকঠাক ব্যবস্থা ছিল না। আর রোগীদের ওয়ার্ডে ধোঁয়া ঢোকা আটকানোর চেষ্টা পুরো ব্যর্থ।”
প্রায় একই সুরে নাগপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীনে ন্যাশনাল ফায়ার সার্ভিস কলেজের অধিকর্তা শামিম বলেন, “হাসপাতালে আগুনের মোকাবিলায় একটা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) বা সাধারণ কৌশল ঠিক করা থাকে। কলকাতার আমরি-তে তার কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। বহুতলটির রক্ষণাবেক্ষন (হাউজকিপিং) থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা গোলমাল ছিল। হাসপাতালের কর্মীরা সতর্ক থাকতে পারতেন।”
আমরি হাসপাতালের ওই ‘দুঃস্বপ্নের ভোরে’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত দমকলের অন্যতম ডেপুটি ডিরেক্টর বিভাস গুহের কথায়, “সুস্থ লোককে বাঁচানো আর রোগীদের উদ্ধার এক জিনিস নয়। রোগীরা অনেকেই জীবনদায়ী ব্যবস্থার সাহায্যে বেঁচে থাকেন। তাড়াহুড়োয় অনেককে হয়তো জানলায় মই লাগিয়ে কোলে করে বের করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ওঁরা রোগী বলেই অনেকে উদ্ধারের ধকলটা সইতে পারেননি।” এনবিসি-র নির্ণায়ক কমিটির বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিশেষ ধরনের এই উদ্ধার-কাজ দমকল ও হাসপাতালের কর্তাদের মধ্যে সমন্বয় রেখে করার কথা ছিল। উদ্ধারের সময়ে রোগীদের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে কি না, দেখার কথা ছিল স্বাস্থ্যকর্মীদের। বাস্তবে, উদ্ধারের সময়ে তাঁরা ছিলেনই না! দিল্লির দমকলের প্রাক্তন ডিজি সতীশ কুমারের কথায়, “হাসপাতালের ভবনের বাইরে র্যাম্প থাকলে রোগীকে ট্রলিতে শুইয়ে বের করা সহজ হতো। হাসপাতালগুলো মোটা টাকা রোজগার করে, কিন্তু নিরাপত্তার এই মৌলিক বিষয়টিতে যত অবহেলা।”
এ রাজ্যে দমকলের প্রাক্তন অধিকর্তা বরেন সেন বলেন, “হাসপাতালে রোগীদের বের করার সমস্যা থাকলে ধোঁয়া দূরে রাখতে পারলেও চলত। এর জন্য ধোঁয়া-রোধক বিশেষ দরজা থাকে। ধোঁয়া ঠেকিয়ে রেখে বাড়তি সময় নিয়ে রোগীদের সাবধানে বের করা যেত। কিন্তু আমরি-তে সে-সব কিছুই হল না।”
অগ্নিকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে দমকলের প্রাথমিক তদন্তে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ‘অজস্র ভুল’-এর এই ছবিটাই উঠে আসছে। যদিও সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, তিন মাস আগে হাসপাতালের আগুন-সংক্রান্ত ছাড়পত্র রিনিউ করার সময়ে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে হাসপাতালের সুরক্ষা-ব্যবস্থা খতিয়ে দেখেছিল দমকল? বস্তুত, কলকাতার নির্মীয়মান ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো রেল ও বিভিন্ন রাজ্যের হাসপাতালের অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জয়ন্ত সাহার অভিজ্ঞতা, “এক বছর আগে আমরি-তে বেসমেন্টে রেডিওলজি-র ইউনিটে এক রোগীকে দেখাতে এনে ঘিঞ্জি, গাদাগাদি অবস্থা দেখে ভয় করছিল। তখনও কিছু দাহ্য পদার্থ রাখা ছিল। দেখলাম, বেসমেন্ট থেকে উপরে উঠতেও লিফট ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর কোনও রাস্তা নেই।” |
এ দিন তদন্ত শুরু করে হাসপাতালের বিরুদ্ধে গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ এনেছে দমকল। দমকল সূত্রে বলা হচ্ছে, যেখানে আগুন লেগেছিল সেই বেসমেন্টের দু’টি ফ্লোর রয়েছে। প্রথম তলাটি অতিদাহ্য বস্তুতে ঠাসা। সেখানেই ওষুধ রাখার ঘরে আগুন ধরেছিল। গত সেপ্টেম্বরেই আমরির ছাড়পত্র পুনর্নবীকরণ করেছিল দমকল দফতর। সে সময় বেসমেন্টে দাহ্যবস্তু রাখার ব্যাপারে দমকল আপত্তি জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হলফনামা দেয় যে, তারা ৯০ দিনের মধ্যে সব সরিয়ে দেবে। এর পরে দমকল ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিষেবা কেন্দ্রকে দমকল কেন এই ‘ছাড়’ দিল, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।
অগ্নিকাণ্ডের পরে দমকলের কর্তারা অবশ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুলগুলো তুলে ধরছেন। দমকলের এক পদস্থ কর্তার কথায়, “এমনিতে তো হাসপাতালে বিপদ-ঘণ্টি গোছের কিছু কাজ করেইনি। উল্টে, আগুন বাড়ছে দেখেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অনুমতি দেননি। তখন হাসপাতালের আলো নিভে গেলে বরং এসি থেকে ধোঁয়া ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকত না।” হাসপাতাল সূত্রের খবর, বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করতে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি দরকার। কেন না বিদ্যুৎ না-থাকলে অনেক রোগী অসুস্থ হয়ে পড়তেন। হাসপাতালের কর্মীদেরও দাবি, আচমকা বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা যায় না। ভেন্টিলেশন-সহ নানা যন্ত্র চালু থাকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। যা শুনে দমকলের এক কর্তার দাবি, “এতেই হিতে বিপরীত হয়েছে। এসি-ডাক্ট থেকে গলগলিয়ে বেরনো বিষাক্ত ধোঁয়ায় এতগুলো প্রাণ একটু একটু করে শেষ হয়ে গিয়েছে।”
হাসপাতালের তরফে দমকলে খবর দিতে কেন দেরি হল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। দমকলের বক্তব্য, হাসপাতালের তরফে বিপদের সময়ে দমকলকে ডাকতে দেরি করা হলেও কয়েক জন নিরাপত্তারক্ষী হোসপাইপে জল দিয়ে বেসমেন্টের আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জেনেছে, ওই হাসপাতালে এ বারই প্রথম আগুন লাগল, এমন নয়। এর আগে বেশ কয়েক বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এবং প্রতি বারই আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিল হাসপাতালের নিজস্ব দমকল বিভাগ।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধদমন) দময়ন্তী সেন বলেন, “হাসপাতালের কর্তারা কোনও কারণে দমকলকে খবর দিতে বারণ করে নিজেদের নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়েই আগুন নেভাতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” পুলিশ এ-ও জেনেছে, বৃহস্পতিবার রাত ২টো নাগাদ বেসমেন্টে আগুন লেগেছে বলে হাসপাতালের দমকল বিভাগকে জানান হাসপাতালের সেন্ট্রাল স্টোরের কর্মীরা। আগুন লাগার ঘটনা ওই দিন রাতে কতর্ব্যরত প্রশাসনিক কর্তা সাজিদ হোসেনকে জানানো হয়েছিল বলেও কর্মীদের দাবি।
হাসপাতালের দমকল বিভাগের এক কর্মী বলেন, “আমরা সেন্ট্রাল স্টোরে গিয়ে দেখি তুলোর কয়েকটি পেটিতে আগুন ধরেছে।” ওই কর্মীর দাবি, ১০টি অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার ব্যবহার করে আগুন নেভানোও হয়। কিন্তু তাপ কমানো যায়নি। হোস পাইপ দিয়ে জল ঢালা হয়। তাতেও কাজ হয়নি। এর পরেই এসি-র ‘ডাক্ট’ দিয়ে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে উপরের তলাগুলিতে। দমকল বিভাগের অবশ্য দাবি, বেসমেন্ট থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র উদ্ধার হয়নি।
আমরি-র অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থাই বা কাজ করল না কেন? দমকলের এক কর্তার অভিযোগ, “বেসমেন্টে স্প্রিংকলারের সুইচটাও অফ করা ছিল। নয়তো আগুনের আভাসটুকু পেলেই স্প্রিংকলার থেকে জল ঝরার কথা। বোধহয় বেসমেন্টে কাগজপত্র ছিল বলেই সে-সব বাঁচাতে হাসপাতালের লোকেরা সুইচটা বন্ধ করে রেখেছিলেন। স্প্রিংকলার কাজ না-করলে আরও কত বড় বিপদ হতে পারে, তা আঁচ করতে পারেননি তাঁরা।”
রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে পারে ভেবে বিপদ-ঘণ্টি বন্ধ রাখার যুক্তি উঠে এলেও দমকল-কর্তারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, হাসপাতালের জন্য একটানা শব্দ করা বিপদ-ঘণ্টি না রাখলেও দপদপ করে জ্বলবে এমন সতর্কতামূলক আলো রাখার রেওয়াজ আছে। ওই আলো জ্বললেও ঢের আগে বিপদ মালুম হত। হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীদের কেউ কেউ আবার ঠারেঠোরে মানছেন, হাসপাতালে আগুন নেভানোর মহড়া হতো না বলে ওই সব সরঞ্জাম তাঁরা অনেকে চোখেই দেখেননি।
আমরি-র বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা বা বাতানুকূল যন্ত্র নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। দমকলের কর্তাদের বক্তব্য, হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় বিদ্যুৎ সংযোগ যত দূর সম্ভব পৃথক রাখা উচিত ছিল। বেসমেন্টে মিনিয়েচার সার্কিট ব্রেক-আপ বা এমসিবি ছিল কি না, দেখতে হবে। ওটা থাকলে তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও বিদ্যুতের লাইন আপনা থেকেই ‘ট্রিপ’ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।”
আমরি-র বেসমেন্টে মূল নকশা অনুযায়ী গাড়ি রাখার কথা থাকলেও কী ভাবে সেই বেসমেন্ট হঠাৎ বদলে গেল, তা নিয়েও কলকাতা পুরসভা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে চলছে বিতর্ক। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো রুখতে রেডিওলজি ইউনিটের জন্য ২০ ইঞ্চি পুরু কংক্রিটের দেওয়াল লাগে। আমরি-তে বেসমেন্ট ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। তাই পুর আইনের ২২৫ ধারায় বেসমেন্টের রদবলটিকে বৈধ করে নেওয়া হয়। পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষের কিন্তু অভিযোগ, এই রদবদল পুরোপুরি বেআইনি। বিষয়টির তদন্ত হবে। শুক্রবার রাজ্য ফরেন্সিক বিভাগের ডিরেক্টর ধুর্জটিপ্রসাদ সেনগুপ্তের নেতৃত্বে একটি দল বেসমেন্ট থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এ দিন দফতরের কেউ হাসপাতালে যাননি। ধুর্জটিবাবু বলেন, “বেসমেন্টে জল থাকায় সব নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি। দমকল জল সরানোর পর ফের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।”
|
ছিল না |
• হাসপাতাল থেকে শায়িত অবস্থায় রোগীদের বের
করতে ভবনের বাইরে নিরাপদ ঢাল বা র্যাম্প।
• বেসমেন্টের ধোঁয়া বহুতলে ঢোকা রুখতে পৃথক ডাক্ট।
• বেসমেন্টের পৃথক ভেন্টিলেশন-ব্যবস্থা।
• আগুন বা গরম ধোঁয়া রুখতে এসিতে ড্যাম্পার কাজ করেনি।
• আগুন বা ধোঁয়া জরিপের স্মোক-ডিটেক্টর কাজ করেনি।
• আগুন টের পেতে সতর্কতার বিপদ-ঘণ্টি কাজ করেনি।
• জল ছিটিয়ে আগুন নেভাতে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার কাজ করেনি।
• আগুন নেভাতে তালিম ছিল না হাসপাতালকর্মীদের। |
সূত্র :ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড |
|