|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
|
হিংসার বিরুদ্ধে
দুনিয়া জুড়ে অগণিত মেয়ে হিংসার শিকার। নারীর ওপর হিংসার
বিরুদ্ধে, মানবাধিকারের দাবিতে পক্ষকাল ধরে অনেক কথা শুনলাম
আমরা। লড়াইটা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে, বলছেন মার্কিন
বিদেশমন্ত্রী
হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টন |
|
একটি মেয়ের কথা ভাবুন। নির্দিষ্ট কোনও দেশ নয়, পৃথিবীর যে কোনও জায়গাই হতে পারে তার ঠিকানা। যে কোনও আর্থ-সামজিক গোষ্ঠীতে তার বাস, যে কোনও জাতিই তার পরিচয়, ধর্মমতও যে কোনও। তার দিন শুরু হয় সূর্যোদয়ের আগে। কোনও দোকানে, কিংবা খেত-এ, কারখানায় বা হয়তো কারও বাড়িতে সে কাজ করে ৮-১২ ঘণ্টা, মজুরি যৎসামান্য, কিন্তু সেইটুকু অর্থেই তার সংসার চলে। সন্তান বা বয়স্ক স্বজনদের প্রতিপালনের জন্য ওইটুকুই তার সম্বল। বাড়ি ফিরে সে বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে, ইস্কুলে কী শিখলি আজ, বা হয়তো, বল তো বড় হয়ে কী হবি? তার পর, ছোট্ট একটা স্টোভ, বা হয়তো উনুনের ওপরে ঝুঁকে আরও কয়েক ঘণ্টা! রান্নাবান্না কে করবে, সে ছাড়া? আর, দুনিয়ার এমন অজস্র জায়গা আছে যেখানে ওই খাবারটুকুও তাকেই ফলাতে হয়, মাঠের ফলন বাড়িতে এনে তার পর মুখে তোলার আয়োজন।
একটু ভেবে দেখুন তো, উপরের এই সব কাজের কোনও একটিও যদি সেই মেয়েটি করতে না পারে অন্য কোনও কারণে নয়, নিতান্তই তার ‘নারী’ এই লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য, তার উপরে নেমে আসা হিংস্রতার জন্য তখন তার দশাটা ঠিক কতটা করুণ হতে পারে? দিন-আনি-দিন-খাই’-এর সংসারে তার চিকিৎসার খরচটুকুও তো বোঝা। তার উপর যদি চূড়ান্ত শারীরিক বা মানসিক আঘাতের দরুন সে যদি আর কাজই করতে না পারে, তখন বাধ্য হয়ে তার ছেলেমেয়েদের ইস্কুল ছাড়তে হয়, কাজ নিতে হয় কোথাও সংসার চালানোর জন্য। পাড়ার যে দোকানটোকান থেকে সে কেনাকাটা করত, সে সব থেমে যায়। দোকানদারও একটি খদ্দের হারায়। তার আয়ের অঙ্কেও কোপ এসে পড়ে।
হতেই পারে যে আপনি এই মেয়েটিকে চেনেন। পৃথিবীর প্রতি তিনটি মেয়ের মধ্যে এক জন এই ধরনের লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসার শিকার। প্রতি পাঁচটি মেয়ের মধ্যে এক জনকে বলাৎকার বা তার চেষ্টা করা হয়। এই সন্ত্রাস ছড়িয়ে আছে জীবনের প্রতিটি ধাপে। জীবনের শুরুতে, যখন কন্যা-শিশুর ভ্রূণহত্যায় বাধ্য হন কোনও মা, যখন স্রেফ ‘বালিকা’ হওয়ার দায়ে কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, যখন ছেলেরা বার দু’য়েক খেয়ে নেওয়ার আগে মেয়েরা খাবারের দিকে হাতই বাড়াতে পারে না! তার পর শিশু বয়সেই বিয়ে, বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে হিংসা, বা যৌন হিংসা!
মহিলা এবং বালিকাদের ওপর এই হিংসা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গেও জড়িত। বিস্তৃত এই হিংসার পরিণাম তাৎক্ষণিক আঘাত বা অর্থনৈতিক ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক সময়েই দেখা যায়, মারাত্মক যৌনরোগের সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। যাঁরা এই ধরনের হিংসার ক্ষত মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের এবং তাঁদের সন্তানদের উপর, পরিবারের ওপর, বলতে গেলে গোটা জনগোষ্ঠীর ওপরেই এসে পড়ছে এই অপকর্মের ছায়া বিপুল সামাজিক এবং মানসিক আঘাত।
ধাঁচটা যে রকমই হোক না কেন, লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসা আসলে মানবিক মর্যাদার লঙঘন। দুঃসহ লঙ্ঘন। ব্যক্তিগত আঘাত বা যন্ত্রণাকে তো মাপা যায় না। কিন্তু, চিকিৎসার খরচ, মামলা-মোকদ্দমার খরচ, যে মজুরিটুকু মিলল না, বা কোনও দিনই মিলবে না, সেই অঙ্ক, ক্ষীণ হয়ে আসা কর্মক্ষমতার দরুন ক্ষতি আর এইচ আই ভি-র বর্ধিত ঝুঁকি-সহ শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার খরচ, এ সব অর্থমূল্যে মাপা সম্ভব। সেই হিসেবটা যখন কষতে বসি, তখন বোঝা যায়, বালিকা এবং নারীদের উপরে হিংসার জেরে সমাজের প্রত্যেককে কতটা দাম দিতে হচ্ছে!
একটা উদাহরণ দিই। উগান্ডায় প্রায় ১৩ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন, ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হিংসাত্মক আচরণে ঘরকন্নার জরুরি কাজে দেরি হয়েছে! এদের কেউ কেউ প্রতি বছরে অন্তত এগারোটি দিন কাজে যেতে পারেন না। মজুরি কাটা যায়। বাংলাদেশে যত পরিবারের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছিল, তার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি জানিয়েছে, গৃহ-সন্ত্রাসের জন্য মাসে গড়পড়তা পাঁচ ডলার করে ক্ষতি হয়। অঙ্কটা অনেক মহিলারই আয়ের প্রায় পাঁচ শতাংশ। যে সব পরিবার মহিলাদের আয়েই চলে, তাদের গায়ে এই ক্ষতির আঁচটা আরও বেশি করে লাগে, এবং সাধারণ ভাবে, সেই ক্ষতিটা যথাসম্ভব কমিয়ে দেখানো হয়।
|
|
অতঃপর? প্যালেস্তাইনি বিদ্রোহী আল বতস-এর কন্যা। ছবি: রয়টার্স |
অথচ, ক্ষতিটা কিন্তু পরিবারের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে না, জনগোষ্ঠীর বাকি লোকজনদেরও তার ফল ভুগতে হয়। কী ভাবে? আইনি কাজকর্মের ব্যয় বেড়ে যায়, চিকিৎসার খরচ, নিরাপত্তার খরচও ঊর্ধ্বমুখী হয়। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই এই অপরাধ থেকে নিস্তার নেই। আমেরিকায়, ২০০৩-এ সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল-এর একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, শুধুমাত্র ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হিংসাত্মক আচরণের দরুন ক্ষতির ব্যয়ভার বছরে পাঁচশো আশি কোটি ডলারের বেশি। তার মধ্যে চারশো দশ কোটি ডলার যায় সরাসরি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের খাতে, আর কর্মক্ষমতা হ্রাসের জন্য ক্ষতির মাত্রা একশো আশি কোটি ডলার।
খেয়াল করে দেখুন, হিংসাত্মক আচরণ যখন মেয়েদের অকর্মণ্য করে রাখছে আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জনগোষ্ঠীকে টানছে অবনমনের দিকে, তখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের যুক্ত করলে কিন্তু জাতীয় আয় এবং ব্যক্তিগত আয় লক্ষণীয় ভাবে বাড়ছে। একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক কাজকর্মে মেয়েদের সফল ভাবে জুড়ে দিতে পারলে, সংশ্লিষ্ট নানা বাধাবিপত্তি দূর করলে মাথাপিছু আয় এমনকী ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আয়বৃদ্ধি মানে আরও একটু ভাল খাওয়াদাওয়া, ছেলেমেয়েদের ইস্কুলে পাঠানো, আরও কিছুটা বেশি কেনাকাটা, ফলে স্থানীয় উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের লাভ, এই ভাবে চক্রাকারে একটি অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গল্প।
প্রতি বছর, ২৫ নভেম্বর (নারীর বিরুদ্ধে হিংসার উচ্ছেদকল্পে আন্তর্জাতিক স্তরে চিহ্নিত দিন) থেকে ১০ ডিসেম্বর (আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস), এই ষোলোটি দিন ধরে আমরা লিঙ্গ-চিহ্নিত হিংসার বিরুদ্ধে নানা রকম কর্মসূচি পালন করি। এই সময়কালের মধ্যে, বিশেষ ভাবে, আমরা এই জাতীয় হিংসার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার শপথ নিই, বিশ্বজুড়ে নারীরা, ছোট মেয়েরা যাতে এই সংকটের শিকার না হয়, তাদের নিরাপত্তা যাতে আরও সুনিশ্চিত করা যায়, সেই মর্মে অঙ্গীকার করি। এই কাজে প্রত্যেকের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। শুধু নারী কেন, বালক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ, জননেতা বা ধর্মীয় নেতা, যুবক-যুবতী এবং সমাজের প্রতিটি স্তরের জনতার অংশগ্রহণ ছাড়া মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া এই হিংসাকে প্রতিরোধ করা যাবে না।
বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে এই অত্যাচার ঘটতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটতে পারে, কারণ সেখানে ‘ধর্ষণ’ রীতিমত একটি অস্ত্র, ঘটতে পারে সেই সব জায়গায় যেখানে শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে মেয়েরা লাঞ্ছিত, সামাজিক অবমাননার শিকার। লাঞ্ছনার ধরন যা-ই হোক, এই অন্যায়কে মেনে নেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জনসংখ্যার অর্ধেক ভাগকে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে, তাদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে, বৈষম্যমূলক আচরণ করে কোনও দেশই এগোতে পারে না।
এ বছর, বিশেষ ভাবে চিহ্নিত সেই ষোলোটি দিনের মেয়াদ সদ্য ফুরোল। আসুন, সবাই মিলে দাবি তুলি, যে বিচিত্র অকর্মণ্যতার ফলে এই জাতীয় হিংসা চক্রাকারে চলতে থাকে, তার অবসান হোক। আসুন, হাত মিলিয়ে সমস্ত রকম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি। চেষ্টা করি, যাতে এই ধরনের অপকর্ম আর না ঘটে!
|
|
|
|
|
|