নিয়ম না মানার তিন কাহিনি। তিনটি গল্প আগুন লাগা তিনটি বাড়ির। স্টিফেন কোর্ট, নন্দরাম মার্কেট এবং সোদপুরের রেডিমেড সেন্টার।
কাহিনি এক: নীচের তলায় রমরম করে চলছে রেস্তোরাঁ এবং বেশ কয়েকটি দোকান। রাতে রঙিন আলো জ্বলে তাতে। অনেক রাত পর্যন্ত গমগম করে এলাকাটা।
কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলেই পুরো অন্য জগত। দিনের বেলাতেও অনেক জায়গায় নিকষ অন্ধকার। টর্চের আলো লাগে পথ চলতে। পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। বিভিন্ন তলে সিঁড়ির ভাঁজে এখনও জমে আছে আগুনে পোড়া জিনিসের স্তূপ। রাতে একতলা ছাড়া পুরো বাড়িটা ভুতুড়ে বলে মনে হয়।
আগুন লাগার পরে দেড় বছর কেটে গেলেও পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের দু’নম্বর লিফট সংলগ্ন গোটা ব্লকটি দেড় বছর আগেকার অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। ছাদ পর্যন্ত উঠতে হবে অন্ধকারে। আশপাশের সব দরজা ও ছাদের কোল্যাপ্সিবল গেট বন্ধ। অগ্নিকাণ্ডের পরে পুরসভার নির্দেশ ছিল, বাড়িটি ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে। ভাঙতে হবে একটি দেওয়াল। দেওয়ালটি আজও অক্ষত।
২০১০ সালের ২৩ মার্চ আগুন লাগার আগে ওই বাড়িতে থাকত ৭০টি পরিবার। তার মধ্যে নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরেছে ১৫টি। কলকাতা পুরসভার বিশেষ অনুমতি নিয়ে। বাকিরা এখনও অনুমতি পাননি বাড়ি ফেরার। তাঁরা পুরসভার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলছেন।
ওই বাড়ির বাসিন্দাদের নিয়ে তৈরি কমিটির সম্পাদক দেবাশিস গুহনিয়োগী বলেন, “আমি মনে করি, যাঁরা এখন ঢুকেছেন তাদের সবাইকে প্রশাসন বের করে দিক। এর ফলে সবার প্রতি ন্যায্য বিচার হবে।”
কী ভাবে প্রশাসন অনুমতি দিল ৩০ শতাংশ বাসিন্দাকে? |
যে যেখানে দাঁড়িয়ে |
স্টিফেন কোর্ট |
• সিঁড়ির তলা থেকে মিটার সরানো
• অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি সারিয়ে তোলা
• যথাযথ ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা
• বাড়ির নীচে জলাধার তৈরি করা
• লোহার ঘোরানো সিঁড়ি ব্যবহারযোগ্য করা
• আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ ভেঙে ফেলা |
নন্দরাম মার্কেট |
• ৬ তলা থেকে ১৩ তলা ভেঙে ফেলা
• বাইরে বেরোনোর জরুরি সিঁড়ি
• ৫ তলা পর্যন্ত বৈদ্যুতিন ব্যবস্থার সংস্কার
• রাস্তায় মালপত্র ডাঁই করে না রাখা
• ভূগর্ভস্থ জলাধার সহ পর্যাপ্ত জলের সংস্থান
• স্মোক অ্যালার্ম, ফায়ার এক্সটিংগুইশার বসানো |
সোদপুরের রেডিমেড সেন্টার |
• দু’টি ঢোকার এবং দু’টি বেরোনোর রাস্তা করতে হবে
• জলাধার তৈরি করতে হবে
• অগ্নি নির্বাপনের জন্য স্প্রিংকল রাখতে হবে
• দোকানের মধ্যে গুদাম রাখা যাবে না
• ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখতে হবে |
|
পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) দেবাশিস কর বলেন, “পুলিশ ছ’মাসের জন্য ওই অনুমতি দিয়েছিল। তার মধ্যে প্রশাসনের সুপারিশ কার্যকর করার কথা ছিল ওঁদের। সেই সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। ওঁরা সুপারিশ মানেনি। তবুও ওঁদের তোলা যাচ্ছে না।”
কাহিনি দুই: রাজনৈতিক সদিচ্ছার ‘অভাব’ যে কতটা তার নিদর্শন দিতেই বুঝি ব্রেবোর্ন রোডের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৩ তলা একটি বাড়ি। নন্দরাম মার্কেট। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও বাড়িটির উপরের আটটি তলা ভাঙা যায়নি। উপরের অংশ ভাঙায় আপত্তি ছিল ব্যবসায়ীদেরও। সেই আপত্তিকে উস্কে দিয়েছে ‘রাজনৈতিক সমর্থন’। তৃণমূল পুর-বোর্ড ক্ষমতায় আসার পরেই মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর্থ-সামাজিক দিককে উপেক্ষা করে কোনও কাজ করতে চান না তাঁরা।
পুরসভা সূত্র বলছে, ১৯৬৭ সালে ওই বাড়ির অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন নকশায় বেসমেন্টের সঙ্গে ছ’তলা তৈরির অনুমতি ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে সেটি ২১ তলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন পুরসভা ১৩ তলার উপরের অংশ ভেঙে দেয়। পুরসভার বক্তব্য, যে হেতু ওই বেআইনি বাড়ির ১৩ তলার উপরে তখনও কোনও ব্যবসা হত না, তাই সেটি ভাঙা হয়। বাকি অংশে ব্যবসা থাকার ফলে তা ভাঙা যায়নি।
পুড়ে যাওয়ার পরে নন্দরাম মার্কেটের বৈধ অংশটি আবার ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল বাড়িটির বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজা এবং বিশেষ সিঁড়ি তৈরি, যেটি কেবল জরুরি
প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার হবে। হয় ভূগর্ভে, নয় ছাদে জলাধার গড়তে হবে। পরামর্শদাতা কমিটির সব সুপারিশ না মানলেও মার্কেটের চেহারা আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল। শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নীচের পাঁচটি তলায় ব্যবসা চলছে। প্রতি তলায় জলের মোটা পাইপ লাগানো। অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র ঝুলছে দেওয়ালে। ১৪-১৫ হাত অন্তর ‘স্মোক অ্যালার্ম’। বহু বছরের পুরনো বিদ্যুতের তার পাল্টে ‘ইনস্যুলেটেড’ তার লাগানো হয়েছে। আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ আছে এমন লোকজনকেও রাখা হয়েছে
নন্দরাম মার্কেটে।
‘নন্দরাম মার্কেট বাঁচাও কমিটি’র সম্পাদক সমরকান্তি চৌধুরী বলেন, “আগুন লাগার পর থেকে বহু বার পুরসভা ও প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বাড়ির পাঁচতলা পর্যন্ত কাঠামোর ক্ষমতা সম্পর্কে যাদবপুর
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শংসাপত্র নেওয়া হয়েছে। এ বার বাকি অংশ সংস্কারের জন্য পুরসভার কাছে আবার আবেদন জানাব আমরা।”
পুরসভার ডিজি (বিল্ডিং) বলেন, “ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতি বাড়ি মেরামতের দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু ওদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বরং জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগে বেআইনি অংশ ভাঙতে দিতে হবে। তার পরে মেরামতের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।”
কাহিনি তিন: ২০০৮ সালের ১৬ মে সোদপুরের স্টেশন রোডে পোশাক-পরিচ্ছদের দোকান রেডিমেড সেন্টারে আগুন লেগে মৃত্যু হয় ১৩ জনের। প্রশাসনের নির্দেশ ছিল, অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই দোকানে দু’টি ঢোকার রাস্তা ও দু’টি বেরনোর রাস্তা
করতে হবে। পাশাপাশি, মৃতদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরি দিতে হবে। এর পরে বহু জল গড়িয়েছে। ব্যারাকপুর আদালতে মামলা চলছে এখনও। ইতিমধ্যে মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দিয়ে সোদপুর স্টেশনে রোডে আবার সেই পোশাক-পরিচ্ছদের দোকান দিব্যি চলছে রমরমিয়ে।
আগুন লাগার কয়েক দিনের মধ্যেই ওই দোকানের দুই মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে আমরি-র মতোই একই ধারায় মামলা করে দমকল ও পুলিশ। পুরসভা বাতিল করে দেয় দোকানের ‘লাইসেন্সও’। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এলাকার তদানীন্তন সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত ঘোষণা করেন, ‘দোষীদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা করা হবে’।
দমকল সূত্রের খবর, এর পরে নতুন করে কাগজপত্র জমা দেয় মালিক পক্ষ। তার ভিত্তিতে তখনকার মতো সব ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে ২০০৯ সালে ফের দোকান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এখন অবশ্য আর একটি দোকান নয়। দুই ভাই ভাগাভাগি করে দু’টি দোকান চালাচ্ছেন। দুই ভাইয়ের অন্যতম জীবনকৃষ্ণ সাহার দাবি, “আইন মেনেই ফের দোকান চালু হয়েছে। আমরা আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছি।”
যদিও নিয়ম অনুযায়ী দু’টি ঢোকার ও দু’টি বেরনোর রাস্তা এখনও করা হয়নি। ভাগ হয়ে যাওয়া দু’টি দোকানেরই সামনের দিকে একটি করে রাস্তা রয়েছে। পিছনেও রয়েছে মাত্র একটি। দমকলের দেওয়া বাকি সব শর্ত ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, তা-ও সম্প্রতি খতিয়ে দেখা হয়নি। |