নেট-বাজারের নাড়ি টিপে দেখতেই সাজানো শো-রুমের বাইরে পা রেখেছিল কলকাতার পোশাক সংস্থা টার্টল। গাঁটছড়া বেঁধেছিল অনলাইন বাজার সংস্থা মিনট্রা ডট কমের সঙ্গে। আর সেই অভিজ্ঞতাই কার্যত চোখ খুলে দিয়েছে তাদের। দেখিয়ে দিয়েছে ইন্টারনেটে বিকিকিনির সাফল্য আর সম্ভাবনা। যে কারণে এ বার নেটে হেঁটে পোশাক বেচতে নিজেদেরই পোর্টাল চালু করতে চায় তারা। সবকিছু ঠিকঠাক চললে, চলতি মাসেই ওয়েবসাইটট চালু হয়ে যাবে বলে সংস্থার দাবি।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও টার্টল আজ আর ব্যতিক্রম নয়। কারণ, এই সম্ভাবনাময় বাজারের আকর্ষণ এড়াতে পারছে না অনেক সংস্থাই। যে কারণে শুধু প্রথাগত বিপণির ধারণায় আটকে না-থেকে নেট-বাজারে দ্রুত পা রাখতে চাইছে তারা। ইন্টারনেটের ঘাড়ে চড়ে আস্ত বাজারকেই তুলে নিয়ে যেতে চাইছে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে। যেমন, গ্রেট ইস্টানর্র্ অ্যাপ্লায়েন্সেস। ছ’মাসেই নিজস্ব পোর্টাল মারফত বৈদ্যুতিন পণ্য বিক্রি শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছে এই সংস্থা।
বাড়িতে বসে কেনা-কাটা সারার রেওয়াজ ইউরোপ, আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়ায় চালু হয়েছে আগেই। এ রাজ্য-সহ ভারতেও তা নতুন নয়। কিন্তু হালে এই বাজার বাড়ছে উল্কাগতিতে। পিছিয়ে নেই কলকাতাও। মার্কিন বহুজাতিক ইবে-র সমীক্ষায়, অনলাইন বাজারের মাপে দেশে অষ্টম স্থানে কলকাতা। পিছনে ফেলেছে তুলনায় বেশি মাথাপিছু আয়ের শহর চণ্ডীগড় ও পুণেকে।
কিন্তু এই তুমুল জনপ্রিয়তার রহস্য কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইন্টারনেটের হাত ধরে এই বাজার আমূল বদলে দিচ্ছে কেনা-কাটার চালু ধারণাকেই। সাধারণত পছন্দের পণ্য কিনতে বাজারে যান ক্রেতারা। অথচ এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের দৌলতে বাজারই হাজির হচ্ছে ক্রেতার দরজায়। ফলে, সময় বাঁচছে। এড়ানো যাচ্ছে গাড়ি পার্কিং বা জিনিস কিনে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো হাজারো ঝঞ্ঝাট। কিন্তু নেট-বাজারের রমরমার তার থেকেও বড় কারণ দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ায় তার অনায়াস দক্ষতা।
এ প্রসঙ্গে টার্টল কর্তা অমিত লাডসারিয়া ও অনলাইন বাজার সংস্থা স্ট্রেটলাইন-এর কর্তা কে সেন্তিলনাথন জানান, উন্নয়নের দৌলতে পোশাক-সহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড পণ্য কেনার আগ্রহ বাড়ছে ভাতিণ্ডার মতো ছোট শহর, এমনকী গ্রামের মানুষের মধ্যেও। কিন্তু সর্বত্র বিপণি খোলা অসম্ভব। ফলে সাধ ও সাধ্য দুই-ই থাকতেও এত দিন ওই সব পণ্য সে ভাবে কিনতে পারতেন না মেট্রো শহরের বাইরের ক্রেতারা। কিন্তু অনলাইনে সে সমস্যা নেই। ঘরে বসে মাউসে ক্লিক করেই কেনা যায় পছন্দের পণ্য। এমনকী কম্পিউটার না-থাকলেও, কেনাকাটা সেরে ফেলা যাবে মোবাইলেই। ইবে-র পরিসংখ্যানেও স্পষ্ট, দেশে নেট বাজারের ৪৯% বিক্রিবাটাই হয় মেট্রো শহরের বাইরে। কিছু ক্ষেত্রে সস্তায় জিনিস পাওয়াও নেট-বাজারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
ঠিক কতটা দ্রুত নেট-বাজার বাড়ছে ভারতে?
উপদেষ্টা সংস্থা প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০৭-এ সপ্তাহে একাধিক বার নেটে বাজার করতেন মাত্র ৪% মানুষ। ২০১০-এ তা এক লাফে বেড়ে হয়েছে ১৪%। ইবে-র হিসাব অনুযায়ী, এখনই দেশে এই বাজার প্রায় ২,৭০০ কোটি টাকার। ফি বছর তা বাড়ছে প্রায় ৪০% হারে। প্রতি ৩ মিনিটে একটি মোবাইল ফোন অ্যাকসেসরি, ৪ মিনিটে গয়না বা স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য সংক্রান্ত পণ্য, ৫ মিনিটে একটি মোবাইল ফোন, ২৭ মিনিটে ল্যাপটপ, আর ৩৯ মিনিটে ১টি ডিজিটাল ক্যামেরা বিকোচ্ছে নেট-বাজারে।
ভবিষ্যতে কি নেট-বাজারের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে চার দেওয়ালের বিপণি?
এ ভাবে বিষয়টিকে দেখতেই নারাজ লাডসারিয়া বা সেন্তিলনাথন। তাঁরা মনে করেন ভবিষ্যতে দু’ধরনের বাজারই চলবে রমরমিয়ে। কেউ আবার মনে করেন, কোনও দিনই বিপণির বিকল্প হবে না নেট-বাজার। কারণ, সেখানে পণ্য ছুঁয়ে দেখা সম্ভব নয়। যেমন, অনলাইনে গয়না বিক্রি বাড়লেও অঞ্জলি জুয়েলার্সের কর্তা অনর্ঘ্য চৌধুরির দাবি, “নিজের জন্য গয়না দোকানে এসেই পছন্দ করতে চান ক্রেতা। কোন গয়না কাকে মানাবে, তা ছবি দেখে বোঝা অসম্ভব। তাই নেট-বাজারে ঢুঁ মারা ক্রেতার অধিকাংশই উপহার বা সস্তায় পুরনো স্টক কেনেন।” আর এই সস্তা বা ‘গ্রেট ডিল’-ই অনলাইন বাজারের মূলমন্ত্র, মনে করেন গ্রেট ইস্টার্ন অ্যাপ্লায়েন্সের কর্তা পুলকিত বেদের মতো অনেকেই। |