হাসপাতালে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে লেখাটা। বড় বড় হরফে দেওয়ালে স্বাস্থ্য দফতরের বিজ্ঞাপনে রয়েছে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসার পরামর্শ। কিন্তু সেই পরামর্শের পথ ধরে ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ঢুকলে বোঝা যায় রাজ্যের আর পাঁচটা সরকরি হাসপাতালের মতোই পরিকাঠামোর দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে এই হাসপাতাল।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যস্ত ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা মানুষদের ‘নেই’-এর ফিরস্তি দিতে দিতে ক্লান্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই। নেই চিকিসার জন্য প্রয়োজনীয় বহু সরঞ্জাম। যে টুকু রয়েছে আছে সেগুলির বেশিরভাগই কর্মীর অভাবে অচল।
রাজ্যে ক্ষমতায় পালা বদলের পরে স্বাস্থ্য দফতরের হাল ফেরাতে নানা পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়। যার অন্যতম ছিল, সরকারি হাসপাতাসল থেকে রোগীদের অন্যত্র ‘রেফার’ না করে সেখানেই রোগীদের আগে চিকিৎসা করতে হবে। নির্দিষ্ট কোনও জটিল রোগ বা চিকিৎসার সরঞ্জাম না থাকলে তবেই ‘রেফার’ করা যাবে। কিন্তু ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এই হাসপাতালে নেই-এর তালিকা এতটাই লম্বা যে, বন্ধ্যাত্বকরণের জন্যও হাসপাতালে আসা রোগীদের রেফার করে দেওয়া হয়। গোটা হাসপাতালে একজন মাত্র স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কাজের চাপে ক্লান্ত ওই চিকিৎসক স্বেচ্ছাবসরের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। শুধু বন্ধ্যাত্বকরণই নয় কোনও বড় অস্ত্রোপচারই হয় না এখানে। কারণ অ্যানাস্থেটিস্ট নেই। |
ভাটপাড়া, শ্যামনগর, নোয়াপাড়া ও নৈহাটির বেশ কিছু এলাকার মানুষ এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। গোটাটাই কল-কারখানায় ঘেরা ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় গরিব রোগীর সংখ্যাই বেশি। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে জরুরি চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদেরও চিকিৎসা হয় জোড়াতালি দিয়ে। স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও এখানে অর্থোপেডিক চিকিৎসক নেই। ফলে হাড়ের চিকিৎসা দূরঅস্ত। হাত-পা ভেঙে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে কোনওরকমে ড্রেসিং করেই অন্যত্র রেফার করে দেওয়া হয়। নিয়মানুযায়ী অন্তত একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ থাকার কথা থাকলেও এখানে তা নেই। একজন মাত্র ইএনটি চিকিৎসক। তবে তিনিও অবসর নেওয়ার মুখে। প্যাথলজিস্ট একজন। ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। রেডিওলজিস্ট না থাকায় রেডিওলজি বিভাগের দামী যন্ত্রে ধুলো জমছে। ওষুধ, ইঞ্জেকশন অধিকাংশই কিনতে হয় বাইরে থেকে। হাসপাতালের একটিই অ্যাম্বুল্যান্স। সেটিও যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিকল। ফলে রোগীদের ভরসা বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠনের বেশি ভাড়ার অ্যাম্বুল্যান্স। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওষুধ কেনার জন্য গত আর্থিক বছরে পাওয়া গিয়েছিল ১৫ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা। চলতি আর্থিক বছরে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ লক্ষে। হাসপাতালে ৬৫ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর মধ্যে বর্তমানে আছেন মাত্র ১৭জন। তাঁরাও নিয়মিত আসেন না।
সুপার স্বাগতেন্দ্রনারায়ণ বসু বলেন, “পরিকাঠামো আর পরিষেবা এই দু’য়ের মেলবন্ধন ঘটাতে গিয়ে প্রতিদিন হিমসিম খাচ্ছি। এত কম চিকিৎসক নিয়ে হাসপাতাল চালানো যায়? যাঁরা কাজ করছেন, কাজের চাপে তাঁরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। স্বাস্থ্য দফতরে একের পর এক চিঠি পাঠিয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এতবড় হাসপাতাল এ ভাবে চালানো কঠিন।’’ তিনি আরও জানান, নিয়ম অনুযায়ী এই ধরনের স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে মাসে মোট রোগীর পাঁচ শতাংশ রেফার করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সেটা ১২ শতাংশ চাড়িয়ে যায়। একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, যে চিকিৎসকেরা হাসপাতালে আছেন তাঁদের কেউ কেউ কাজ করলেও অনেকেই বেহাল পরিকাঠামোর দোহাই দিয়ে হাসপাতালে সময় দেন না। ফলে সমস্যা আরও বাড়ে। ভাটপাড়া হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক অজয় পাল, ‘‘পরিকাঠামো নিয়ে সমস্যা আছে। তবে সরকার চাইলেও রাতারাতি এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। যতটুকু পরিকাঠামো আছে সেটুকুও ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় কি? চেষ্টা করছি স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটানোর।’ |