১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম সঙ্গীতা থাপা-র। আর ১৯ বছর পরে ঠিক সেই দিনটাতেই পুনর্জন্ম হল তার।
মাতৃজঠরে মায়ের রক্ত আর মাংসে গড়ে ওঠে সব শিশুই। তবু অন্য সাধারণ শিশুদের থেকে সঙ্গীতা অনেকটাই আলাদা।
কী ভাবে আলাদা হল সে?
সঙ্গীতা আলাদা। কারণ, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেও বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে মায়েরই অস্থিমজ্জার উপরে।
কেন?
জন্ম থেকেই জিনঘটিত রোগ ডায়মন্ড ব্ল্যাকফ্যান অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত সঙ্গীতা। এই রোগে লোহিত রক্তকণিকাগুলি ভেঙে যায়। কোনও ওষুধে এই রোগ সারে না। মায়ের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করে সঙ্গীতাকে ওই রোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসকেরা। মঙ্গলবার তাঁরা দাবি করলেন, মায়ের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সফল হয়েছে। আর সঙ্গীতার জন্মদিনেই তার পুনর্জন্মের কথা ঘোষণা করলেন চিকিৎসকেরা। যার পিছনে মূল অবদান মেয়েটির মা শান্তি থাপারই।
মঙ্গলবার পার্ক স্ট্রিটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সঙ্গীতার জন্মদিন পালন করলেন চিকিৎসক ও নার্সেরা। পুরো অনুষ্ঠানটাই হল হাসপাতালের আইসিসিইউ-এর ভিতরে। কেক কাটল সঙ্গীতা। জীবাণু নিরোধক পোশাক এবং মুখে মাস্ক পরে শান্তিদেবী কেক তুলে দিলেন মেয়ের মুখে। পাশে দাঁড়ানো সিস্টারেরা গেয়ে উঠলেন, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।’ |
মায়ের শরীর থেকে নেওয়া অস্থিমজ্জা সঙ্গীতার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। তাঁদের প্রচেষ্টা যে সফল হয়েছে, তা বোঝার জন্য সময় নিচ্ছিলেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের চিকিৎসার চূড়ান্ত ফল ঘোষণার জন্য মেয়েটির ১৯তম জন্মদিনটিকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। এ দিন তাঁরা সঙ্গীতার মাকে জানিয়ে দিলেন, তাঁদের পরীক্ষা সফল। চিরকালের মতো রোগমুক্ত হয়েছে সঙ্গীতা।
ডায়মন্ড ব্ল্যাকফ্যান অ্যানিমিয়া রোগটি কতটা মারাত্মক?
সঙ্গীতার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, এই রোগে রক্তের লোহিত রক্তকণিকা ক্রমাগত ভাঙতে থাকে। সমস্যা হল, এর কোনও প্রতিষেধক নেই। ফলে রোগী কত দিন বেঁচে থাকতে পারে, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। প্রতি মাসে রক্ত দিতে হয় পাঁচ থেকে ছ’বার। অনেকেরই এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালানোর সামর্থ্য থাকে না। অনেক সময় রোগী বারবার রক্ত নেওয়ার ধকলও সইতে পারে না।
সঙ্গীতাকে নিয়ে ভেলোরে ঘুরে এসেছিলেন বাবা-মা। পার্ক স্ট্রিটের বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। সঙ্গীতার চিকিৎসক আশিসবাবু বলেন, “রক্ত তৈরি হয় অস্থিমজ্জা থেকেই। তাই সঙ্গীতার অস্থিমজ্জা বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওর দাদা, দিদি বা বাবার সঙ্গে ‘জেনেটিক ম্যাচিং’ হয়নি। মিল পাওয়া গেল মায়ের সঙ্গে। যা সচরাচর দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে মিল পাওয়ার পরেই সঙ্গীতার দেহে মায়ের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।” |
৬ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয় সঙ্গীতা। প্রথমে তার শরীরের সব অস্থিমজ্জা নষ্ট করে ফেলা হয়। ২০ নভেম্বর মায়ের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপিত হয় মেয়েটির দেহে। মেয়ের শরীর মায়ের অস্থিমজ্জা নিতে পারবে কি না, সেই বিষয়ে চিকিৎসকদের সন্দেহ ছিল। হঠাৎই সঙ্গীতার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। তবে শেষ পর্যন্ত জয় হল চিকিৎসাবিজ্ঞানেরই। তাকে যে আর অন্যের রক্তের উপরে নির্ভর করে থাকতে হবে না, তা জেনে প্রায় বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিল সঙ্গীতা। দীর্ঘ ক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারেনি সে। আর শান্তিদেবী? শুধু মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদেই চলেছেন তিনি।
আশিসবাবুদের এই প্রচেষ্টা কতটা বিরল ঘটনা?
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইনস্টিটিউট অফ হেমাটোলজি অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন মেডিসিনের প্রধান উৎপল চৌধুরী এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজির প্রধান মলয় ঘোষ জানিয়েছেন, পূর্ব ভারতে এই ভাবে মায়ের অস্থিমজ্জা নিয়ে সন্তানের ব্ল্যাকফ্যান অ্যানিমিয়া-মুক্তির কথা আগে শোনা যায়নি।
ব্যতিক্রমী রোগ জয় করে মায়ের অস্থিমজ্জা শরীরে নিয়ে জন্মদিনেই দ্বিতীয় জীবন শুরু হল সঙ্গীতার। |