রাজ্য সরকার অনড়, ধর্মঘটের জন্য মাধ্যমিক পরীক্ষার দিন বদলাবে না। রাজনীতির কারবারিরা অনড়, পরীক্ষার জন্য ধর্মঘটের দিন বদলাবে না। এই অবস্থায় প্রথম পলক ফেলার ইঙ্গিত অবশ্য মিলল ধর্মঘটকারীদের তরফেই।
ধর্মঘটকারী ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের তরফে এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস দাশগুপ্ত সমস্যা সমাধানের জন্য আর্জি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই। একই সঙ্গে তিনি ইঙ্গিত দিলেন, মমতার সরকার শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার দিন পরিবর্তন না-করলে এ রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে ‘উপযুক্ত’ সিদ্ধান্ত নেবেন। গুরুদাসবাবু স্পষ্ট করে কিছু না-বললেও সিপিএম এবং সিপিআই সূত্রের খবর, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘটে পরিবহণ ক্ষেত্রকে ‘ছাড়’ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দলীয় স্তরে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম-বিরোধী আর্থিক নীতির প্রতিবাদে ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসের আইএনটিইউসি, বিজেপি-র বিএমএস, সিপিএমের সিটু ও সিপিআইয়ের এআইটিইউসি-সহ মোট ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের (শিল্প ধর্মঘট নয়) ডাক দিয়েছে। কিন্তু সেই দিন যেমন রাজ্যে মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষা আছে, তেমনই আইসিএসই, আইএসসি-র মতো সর্বভারতীয় পরীক্ষাও আছে। রাজ্য এখনও পর্যন্ত মাধ্যমিকের দিন পরিবর্তনের কথা বিবেচনা করতে রাজি নয়। ধর্মঘটকারীরা তাঁদের কর্মসূচির পক্ষে যুক্তি খাড়া করেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে পরীক্ষার দিন বদলের আর্জি জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার সূচি পরিবর্তন না-হলে রাজ্যের জন্য কিছু পৃথক ব্যবস্থার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের কোপ কেন লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীদের উপরে পড়বে, সেই বিতর্ক ফের গতি পেয়েছে।
গুরুদাসবাবু মঙ্গলবার বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন, ধর্মঘট এবং পরীক্ষার মধ্যে কৃত্রিম সংঘাত তৈরি করতে দেবেন না। প্রতিবাদ করার অধিকার সকলের আছে, আপনিও মানেন। তাই আপনার কাছে আবেদন, বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে শিক্ষা বড় না ধর্মঘট বড়, এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক শুরু হতে দেবেন না!” একই সঙ্গে প্রবীণ সাংসদের বক্তব্য, “যাঁরা শ্রমিক আন্দোলন করেন, তাঁদেরও ছেলেমেয়ে আছে। তারাও পরীক্ষা দিতে যায়। শ্রমিকেরা অমানবিক নন! যদি একান্তই পরীক্ষার দিন বদলানো না-হয়, তা হলে পরীক্ষার্থীদের যাতে অসুবিধা না-হয়, সেই দিকে খেয়াল রেখেই এ রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেবেন।”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার পরীক্ষার দিন শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন না-করলে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর কথা ভেবে ধর্মঘটের আওতা থেকে পরিবহণকে বাদ রাখা যেতে পারে।” তবে এ ব্যাপারে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আলিমুদ্দিনের একাংশের মতে, রাজ্য অনড় থাকলে এবং সিপিএমও ‘নমনীয়’ মনোভাব না-নিলে বামেদের সম্পর্কেই মানুষের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে।
ক্ষমতায় আসার কিছু দিন আগে থেকেই তৃণমূল নেত্রী মমতা যে হেতু বন্ধ-অবরোধের পথে না-যাওয়ার কথা বলে আসছেন, তাই এখন ধর্মঘটের জন্য তাঁর সরকারের পরীক্ষা না-পিছনোর সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থানের সঙ্গে ‘সঙ্গতিপূর্ণ’ বলেই তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যা। ধর্মঘটকারীদের বক্তব্য, ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটি তাঁরা ঠিক করেছিলেন কেন্দ্রীয় বাজেটের আগের দিন ‘প্রতীকী’ প্রতিবাদের জন্য। সে দিন কোন রাজ্যে কী পরীক্ষা আছে, তাঁদের জানা ছিল না। তার জন্য তাঁরা ‘দুঃখিত’। কিন্তু রাজ্য সরকার ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ নিয়ে কাজ করছে।
পাল্টা হিসাবে ধর্মঘটকারীরা বলছেন, নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিচালনা এবং ১৪ জনের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে ২০০৭ সালের ১৬ মার্চ বাংলা বন্ধ ডেকেছিলেন তৎকালীন ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র নেত্রী মমতা। সেই বন্ধের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হয়েছিল। পিছিয়ে গিয়েছিল আইসিএসই, আইএসসি পরীক্ষাও। গুরুদাসবাবুরা এখন যে আর্জি জানাচ্ছেন, বিরোধী নেত্রী মমতা সে দিন ঠিক একই আবেদন করেছিলেন।
তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য বলেন, “তাৎক্ষণিক ঘটনা ঘটলে স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ হয়। ১৪ মার্চ ১৪ জনের মৃত্যুটাও মনে রাখতে হবে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা রাজ্য আলোড়িত হয়েছিল। সেটা কেউ পরিকল্পনা করে করেনি! সেই বন্ধের সঙ্গে এই ধর্মঘটের তুলনা না-করলেই ভাল হয়। করলেও মানুষ সেটা মেনে নেবেন না!”
গুরুদাসবাবুর আবার পাল্টা প্রশ্ন, “যুক্তি আর জেদ এক করে ফেললে চলবে না! সে বার যদি দু’দিনের নোটিসে উচ্চ মাধ্যমিক পিছনো যায়, এ বার তিন মাসের নোটিসে মাধ্যমিক পিছনো যায় না?” |