মগরাহাটের মতো অশান্তি এড়াতে এ বার বিদ্যুৎ চুরি ঠেকানোর অভিযানে পুলিশ পাঠানোর পদ্ধতিটাই বদলে ফেলা হচ্ছে। বড় মাপের হুকিং-বিরোধী অভিযানে বাহিনী পাঠানোর আগে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)-র অনুমতি নিতে হবে স্থানীয় পুলিশকে। মগরাহাটে গুলিচালনা ও প্রাণহানির ঘটনায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই নির্দেশ দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। পুলিশকর্তাদের আশা, নতুন নির্দেশ মেনে চললে মগরাহাটের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সহজ হবে।
বিদ্যুৎ চুরি রুখতে কোথাও অভিযান চালাতে হলে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা ২৪ ঘণ্টা আগে স্থানীয় থানাকে তা জানিয়ে দেয়। সেই অনুসারে বাহিনী তৈরি রাখে থানা। তারা বাহিনী দিতে না-পারলে অভিযানের দিনক্ষণ বদলে দেয় বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। পুলিশি সূত্রের খবর, এই ধরনের অভিযানের খবর এত দিন সাধারণত মহাকরণে পৌঁছত না। এসডিপিও পর্যায়েই সিদ্ধান্ত হয়ে যেত। কিন্তু মগরাহাট-কাণ্ডের পরে সেই পদ্ধতি বদলে ফেলতেই হচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর।
সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কেন?
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটে বিদ্যুতের হুকিং কাটার অভিযানে পুলিশের গুলিতে দু’জন মারা যান। আহত এক জনের মৃত্যু হয় পরে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুযোগ করেছিলেন, মহাকরণে হাজির থাকা সত্ত্বেও মগরাহাটে গুলিচালনার কথা তাঁকে ঠিক সময়ে জানানো হয়নি। মগরাহাটে যে এত বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তার খবরও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তাদের কাছে ছিল না। সেখানে পুলিশ ও বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার অফিসার ও কর্মীরা আক্রান্ত হওয়ার পরেই রাজ্য পুলিশের বড় কর্তারা পুরো বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মগরাহাটের মতো সংবেদনশীল এলাকায় যে র্যাফ পাঠানো হচ্ছে, তার খবর মহাকরণের কর্তাদের কাছে ছিল না। ভবিষ্যতে যাতে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না-হয়, সেই জন্যই ডিজি-র এই নয়া নির্দেশিকা।
কী আছে ডিজি-র নির্দেশে?
• এ বার থেকে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা কোনও অভিযানে পুলিশের সাহায্য চাইলে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে তা জানাতে হবে জেলার পুলিশ সুপারকে।
• এসপি গোয়েন্দা দফতরের অফিসার-কর্মীদের হুকিং-অধ্যুষিত এলাকায় পাঠিয়ে অভিযানে কী ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হতে পারে, সেই বিষয়ে রিপোর্ট নেবেন।
• বড় মাপের গণ্ডগোলের আশঙ্কা থাকলে এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)-কে জানাবেন এসপি।
• এডিজি-র নির্দেশ মেলার পরেই ক’জন পুলিশকর্মী কী ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে যাবেন, তা
চূড়ান্ত হবে।
এই নির্দেশের ফলে লোকসান এড়ানোর অভিযান গোড়াতেই কিছুটা ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। কারণ, অনেক সময় খবর ফাঁস হয়ে গেলে হুকিংয়ের সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়। বিদ্যুৎকর্মী ও পুলিশ অভিযানে গিয়ে হুকিংয়ের চিহ্ন খুঁজে পান না। সেই কারণে অভিযান চালানো হয় আচমকাই। এবং অভিযানের ঠিক আগের মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট থানাকে তা জানিয়ে পুলিশ চাওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ভাবেই কাজ হচ্ছে। তাতে সাফল্যও মিলেছে। কিন্তু থানায় সাহায্য চাওয়ার পরে রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্তার অনুমতি আনতে আনতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে। তাতে জটিলতা বাড়তে পারে বলে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার অফিসারদের অনেকেরই অভিমত।
বণ্টন সংস্থার এক শীর্ষ কর্তা জানান, আগামী দিনে রাজ্য পর্যায়ে পুলিশ-প্রশাসনের কোনও সমন্বয় বৈঠক হলে সেখানে বিষয়টি তোলা হবে।
পুলিশ অবশ্য বলছে, জটিলতা কিংবা অনুমতি পেতে দেরি হওয়ার আশঙ্কা অযৌক্তিক। বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপারদের একাংশ জানান, সাধারণত অধিকাংশ হুকিং-বিরোধী অভিযানের অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে থানার কাছে বাহিনী চায় বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। এত দিন থানা থেকেই ওসি বা আইসি পরিস্থিতি আঁচ করে পুলিশ পাঠাতেন। নতুন নির্দেশের ফলে এসপি গোটা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে জেলা সদরের বাছাই অফিসার-কর্মীদের পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারবেন। কোথাও বড় মাপের প্রতিরোধের সম্ভাবনা জানলে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরও।
সেই বাড়তি ব্যবস্থাটা কী রকম? একাধিক জেলার এসপি জানান, থানার অফিসারদের দৈনন্দিন আইনশৃঙ্খলা, ‘ভিআইপি ডিউটি’ ও মামলার তদারকিতে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। সেই জন্য হুকিং-বিরোধী অভিযানে অনেক সময়েই দক্ষ ও অভিজ্ঞ অফিসার-কর্মীদের পাঠানো হয় না। এখন থেকে ওই ধরনের অভিযানে এলাকার গুরুত্ব বুঝে বাছাই করা অফিসার-কর্মীদের পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারবেন পুলিশকর্তারা। এক পুলিশকর্তার ব্যাখ্যা, “থানার অফিসার-কর্মীদের উপরে যা চাপ থাকে, তাতে সব সময় সকলে এত ভেবেচিন্তে পা ফেলতে পারেন না। সেই জন্যই এ বার হুকিং-বিরোধী অভিযানে অনুমতির প্রক্রিয়ায় এসপি থেকে এডিজি পদমর্যাদার অফিসারদের সামিল করা হচ্ছে।” |