বাম বা বিজেপি নয়, মূলত শরিক নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই মাত্র চার দিন আগে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কাল সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি মেনেই জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলির উন্নয়নের স্বার্থে ‘বিশেষ যোজনায়’ অনুমোদন দিতে পারে কেন্দ্র। ৮৭৫০ কোটি টাকা আয়তনের ওই ‘বিশেষ যোজনা’-য় (স্পেশ্যাল প্ল্যান ফর ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ন গ্র্যান্ট ফান্ড) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থ বিষয়ক কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব পেশ করা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনা ও অনগ্রসরতার কারণে অতীতে যে ভাবে বিহার, বুন্দেলখণ্ড বা ওড়িশার কালাহান্ডি-বোলাঙ্গির-কোরাপুট কেন্দ্রের ‘বিশেষ যোজনা’ বরাদ্দ পেয়েছে, ঠিক সে ভাবেই জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নের দরজা খুলতে চাইছে কেন্দ্র। ক্যাবিনেট নোটে এ-ও বলা হয়েছে, এই যোজনার আওতায় যত বেশি সম্ভব প্রকল্পকে চলতি আর্থিক বছরের মধ্যেই ছাড়পত্র দিতে হবে যোজনা কমিশনকে। পাশাপাশি মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের ‘জেলাভিত্তিক সুসংহত উন্নয়ন কর্মসূচির’ আওতায় পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও কাল মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেতে পারে। |
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা যে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের জন্য স্পেশ্যাল প্ল্যান বা বিশেষ যোজনা ঘোষণা করতে চলেছে, তা রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই মনে করছেন, এই পদক্ষেপের মধ্যে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের আস্থার সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টাই নিহিত রয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা তথা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য শাকিল আহমেদের কথায়, “তৃণমূল নেত্রী খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ব্যাপারে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে আপত্তি করার সঙ্গে ‘স্পেশাল প্ল্যানের’ কোনও সম্পর্ক নেই। উন্নয়নের প্রশ্নে কংগ্রেস কখনও রাজনীতি করে না। বরং পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নে কংগ্রেস বদ্ধপরিকর।”
মমতার ঘনিষ্ঠ সূত্রেও বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের জন্য উন্নয়ন প্যাকেজের দাবি এবং খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি নিয়ে তৃণমূলের বিরোধিতা সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। তৃণমূল সূত্রে এ-ও বলা হচ্ছে, শুধু জঙ্গলমহল ও পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নের জন্য অর্থবরাদ্দ করলেই যে কংগ্রেস মমতাকে খুশি করতে পারবে, এমনটা ধরে নিলে ভুল হবে। উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের সাহায্য তো চাই। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান দাবি, ৩৪ বছরের বাম শাসনে রাজ্যের যে দেউলিয়া অবস্থা হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে যথাযথ আর্থিক প্যাকেজ দিক মনমোহন সিংহের সরকার। সেই দাবি পূরণে কেন্দ্র যত দেরি করবে, রাজ্য ততই পিছিয়ে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে আজ বলা হয়েছে, জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়ে গত জুলাই মাসে মনমোহনকে চিঠি লেখেন মমতা। তাঁর বক্তব্য ছিল, ওই সব এলাকার উন্নয়নের জন্য রাজ্যের অর্থ-সমস্যা বড় প্রতিবন্ধক। তাই কেন্দ্র এ জন্য আর্থিক সাহায্য করুক। মুখ্যমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়েই প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও যোজনা কমিশনকে রাজ্যের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে প্রণববাবু এর পর ধারাবাহিক বৈঠক করেন। রাজ্যের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয় যোজনা কমিশনের উপাধ্যক্ষ মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গেও। তার পর ‘বিশেষ যোজনার’ খসড়া প্রস্তাবে অগস্ট মাসেই নীতিগত অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে কেন্দ্রের সম্মতির বিষয়টি তখনই মমতাকে জানিয়ে দিতে প্রণববাবুকে নির্দেশও দেন তিনি। যোজনা কমিশন ক্যাবিনেট নোটটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ৩০ নভেম্বর ক্যাবিনেট সচিবালয়ের কাছে পাঠিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ক্যাবিনেট নোটে বলা হয়েছে, ‘জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলির উন্নয়ন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ বিবেচনা করে ‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিওন গ্র্যান্ট ফান্ড’ (বিআরজিএফ) তথা অনগ্রসর এলাকা উন্নয়ন তহবিলের ছাতার তলায় বহুস্তরীয় উন্নয়নের যোজনা তৈরি করা হবে। রাজ্যের আর্থিক দায় ও রাজস্ব আদায়ের চিত্র এবং যোজনা কমিশনের সমীক্ষার ভিত্তিতে স্থির হয়েছে, এ জন্য কেন্দ্র ৮৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করবে’। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা বা ইন্দিরা আবাসের মতো কেন্দ্রের অনুদানে চলা বর্তমান প্রকল্পগুলির সঙ্গে ‘বিশেষ যোজনার’ তেমন সম্পর্ক নেই। এই যোজনার আওতায় পিছিয়ে পড়া এলাকার সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য রাজ্যকে সুনির্দিষ্ট সব প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। তার পর প্রকল্প মাফিক বরাদ্দ দেবে কেন্দ্র। মোট বরাদ্দ তথা ৮৭৫০ কোটি টাকার একাংশ চলতি আর্থিক বছরেই দেওয়া হবে। বাকি টাকা প্রকল্প মাফিক দ্বাদশ যোজনায় বরাদ্দ করা হবে।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, ‘বিশেষ যোজনা’ ঘোষণার অতীত দৃষ্টান্ত বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, বিপুল আয়তনের বরাদ্দ পেতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ। এর আগে বিহার ঠিক একই মাপের ‘বিশেষ যোজনা’ পেয়েছে। বুন্দেলখণ্ডের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ১৪৪০ কোটি টাকা এবং কালাহান্ডি-বোলাঙ্গির-কোরাপুটের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ১৩০ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “বিজেপি বা এনডিএ যাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ না তুলতে পারে, তাই বিহারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ যোজনার আয়তন সমান রাখা হয়েছে।”
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ‘বিশেষ যোজনার’ আওতায় জঙ্গলমহল-সহ রাজ্যের অনগ্রসর এলাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে যোজনা কমিশনের অধীনে একটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি’ গঠন করে দেবে কেন্দ্র। সেই কমিটিতে যোজনা কমিশন, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক, রাজ্যের অর্থ দফতর ও কেন্দ্র-রাজ্যের সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতিনিধিরা থাকবেন। রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য যে প্রস্তাব পাঠাবে, তা ওই কমিটি খতিয়ে দেখবে। মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের জেলাভিত্তিক সুসংহত উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বাঁকুড়া ও পুরুলিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা সম্প্রতি জঙ্গলমহল সফরে গিয়ে জানিয়েছিলেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। কাল সেই প্রস্তাবও চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ নিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে প্রশ্ন যে উঠবে, সন্দেহ নেই। তা ছাড়া এর কৃতিত্ব নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেস-তৃণমূল টানাটানির সম্ভাবনাও রয়ে গেল ষোলো আনা। যার ইঙ্গিত দিয়ে শাকিল আহমেদ আজ বলেন, “ভুলে গেলে চলবে না জঙ্গলমহল ও পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এলাকার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের অর্থ সাহায্য দাবি করেছিল প্রদেশ কংগ্রেসও। প্রধানমন্ত্রীর কলকাতা সফরে প্রদেশ কংগ্রেসের প্রতিনিধি দল তাঁর সঙ্গে রাজভবনে দেখা করে এ ব্যাপারে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। কারণ কংগ্রেসও চায়, ৩৪ বছরের বাম শাসনে পশ্চিমবঙ্গের যে বিস্তীর্ণ এলাকা পিছিয়ে পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠে দ্রুত উন্নয়নের মুখ দেখুক মানুষ।” |