রাজস্ব আদায় বাড়াতে তিনি ‘ভাল’ করদাতাদের জন্য ইনাম ঘোষণা করেছিলেন। ‘অসাধু’দের জন্য দিয়েছিলেন শাস্তির দাওয়াই। তাঁর ঘোষণা ছিল, করের হার না-বাড়িয়েই রাজ্যের কোষাগারে বাড়তি ৩০% টাকা আনবেন তিনি।
কিন্তু চলতি অর্থবর্ষের (২০১১-১২) সাত মাস পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে, বাড়তি রাজস্ব আদায়ের সেই লক্ষ্যে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। কেন?
রাজ্য অর্থ দফতরের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা: অর্থমন্ত্রীর বহু পরিকল্পনাই কার্যত খাতায়-কলমে থেকে গিয়েছে। বাস্তবায়িত হয়নি। যার দরুণ চলতি অর্থবর্ষের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে গড় বৃদ্ধির হার সাকুল্যে সাড়ে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক! যার জন্য অবশ্য বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কট ও তার জেরে উদ্ভুত অনিশ্চয়তাকেও কিছুটা দায়ী করছে অর্থনীতি ও শিল্পমহলের একাংশ। যাদের মতে, এই ধরনের আর্থিক ডামাডোলের বাজারে রাজস্ব আদায় এমনিতেই কিছুটা মার খেতে বাধ্য।
কিন্তু ঘটনা হল, এ হেন পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অর্থবর্ষের বাকি পাঁচ মাসে (নভেম্বর থেকে মার্চ) রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশেরও উপরে নিয়ে যেতে হবে। যা কি না রাজ্য অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, “অত্যন্ত কঠিন।” আবার অফিসারদের আর এক অংশের মন্তব্য, “অত্যন্ত কঠিন বললে কিছুই বলা হয় না। আগের সাত মাসের এই বিপুল ঘাটতি অর্থবর্ষের শেষ পাঁচ মাসে মিটিয়ে ফেলা কার্যত অসম্ভব।” |
অমিতবাবু অবশ্য মহাকরণে জানিয়েছিলেন, তাঁর সরকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দিকেই এগোবে। তাঁর দাবি ছিল, অর্থবিলে রাজস্ব আদায়ের যে সব প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা বাজারে ঠিক ভাবেই কাজ করছে। ফলে চলতি অর্থবর্ষের শেষে রাজস্ব আদায় ৩০% বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করবে বলে অর্থমন্ত্রী তখন আশা প্রকাশ করেছিলেন। প্রথম সাত মাসের এই হিসেবের প্রেক্ষিতে তাঁর বক্তব্য কী?
এ বিষয়ে মঙ্গলবার অমিতবাবু কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে অথর্র্ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, “সেপ্টেম্বর-অক্টোবর উৎসবের মরসুম হওয়ায় সাধারণত স্ট্যাম্প ডিউটি বা রেজিস্ট্রেশনের মতো কিছু কিছু ক্ষেত্রে থেকে রাজস্ব আদায় কমই থাকে। নভেম্বর থেকে তা আবার বাড়তে শুরু করে। এ বছর নভেম্বর থেকেও বিক্রয়কর-ভ্যাট এবং অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের বেশি হারে কর আদায় হচ্ছে।” অর্থবর্ষের শেষ নাগাদ রাজস্ব আদায় যে কিছুটা বাড়ে, দফতরের অন্য কর্তারাও তা মানছেন। এক জনের কথায়, “আমাদের অভিজ্ঞতা হল, বছরের শেষাশেষি আদায় প্রথম দিকের তুলনায় ৫%-১০% শতাংশ বাড়ে।” অবশ্য তিনি এ-ও জানাচ্ছেন, “তবু এ বার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর আশা প্রায় নেই-ই।”
বস্তুত চলতি অর্থবর্ষের দিন যত গড়াচ্ছে, কর আদায় ক্রমশ কমছে। দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অগস্ট-সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ২০%। অক্টোবরে এসে তা প্রায় সাড়ে ৪% কমে গিয়ে সাড়ে ১৫ শতাংশের আশপাশে দাঁড়িয়েছে। অথচ গত অর্থবর্ষের (২০১০-১১) প্রথম সাত মাসে (এপ্রিল-অক্টোবর) তা ছিল ২৭.৫৯%! এ বার এই হাল কেন?
অর্থ দফতরের ব্যাখ্যা: যে সব ক্ষেত্র থেকে কর বাবদ সরকারের কোষাগারে বেশি অর্থ আসে, গত অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসের তুলনায় এ বার তার প্রায় সবগুলো থেকেই আদায় কমেছে। উল্লেখ্য, রাজস্ব বাবদ রাজ্য সরকারের আয়ের মূল উৎস হল বিভিন্ন পণ্যের বিক্রয়কর ও ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি এবং রেজিস্ট্রেশন ফি। এ ছাড়া আবগারি শুল্ক বসিয়ে, কয়লা ও স্পিরিটে সেস চাপিয়ে সরকারের আয় হয়। বিনোদন কর, বিলাস কর, বিদ্যুৎ মাসুল-সহ আরও কিছু পথেও রাজ্যের কোষাগারে টাকা আসে। দফতর-সূত্রের খবর, এ বছরে ৬৩৯০ কোটি টাকা বাড়তি আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল, যার একাংশ পাওয়ার কথা ছিল মদ, অনলাইন লটারি ও তামাকজাত দ্রব্যে কর বসিয়ে। কিন্তু ওই সব খাতেও আদায় আশানুরূপ হচ্ছে না।
দফতরের হিসেব বলছে, গত অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সামান্য বেশি। সে বার আগের বছরের ওই সময়ের তুলনায় কর আদায় বেড়েছিল ২৭.৫৯%। অন্য দিকে চলতি বছরে ওই একই সময়ে কোষাগারে আয় হয়েছে ১২ হাজার ৩১৩ কোটি। কিন্তু বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১৫.৫৪%। রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধি এ ভাবে মার খাওয়ার কারণ কী?
অর্থনীতির এক শিক্ষকের ব্যাখ্যা, “এক দিকে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক ডামাডোল চলছে। অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গে এখন নতুন সরকার। শিল্প-বাণিজ্য-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন-নতুন নীতি গৃহীত হচ্ছে। আর্থিক ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার নিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে। তার জেরে লগ্নিকারী ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নিচ্ছে। এরই কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে।” |