বিভ্রান্তি পুলিশের নিচু তলায়
আগ্নেয়াস্ত্রে লাগাম টানতে নির্দেশ ডিজির
দিয়ার বগুলায় গত ৭ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। তাতে এক গৃহবধূর মৃত্যু হওয়ার পরে অস্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারে সব থানাকে সতর্ক করেছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। এ বার মগরাহাটে পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যুর পরে রাজ্যের সব থানা থেকে (মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা ছাড়া) যাবতীয় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন ডিজি। পাশাপাশি তিনি এ-ও জানিয়েছেন, থানার কনস্টেবল পদমর্যাদার কর্মীরা এখন থেকে আর রাইফেল ব্যবহার করতে পারবেন না।
তবে লিখিত ভাবে এই নির্দেশ কিন্তু দেননি ডিজি। তাঁর মৌখিক নির্দেশ বিভিন্ন অফিসারের মাধ্যমে জেলায় জেলায় পৌঁছেছে। অস্ত্র জমা দেওয়া নিয়ে ডিজি কী বলেছেন, তা যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় ওই নির্দেশে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কোনও কোনও জেলায় পুলিশ ফাঁড়ি এবং ক্যাম্পগুলি থেকে শুধু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রই নয়, সব ধরনের বন্দুক জমা পড়তে শুরু করেছে থানায়। ফাঁড়ি এবং ক্যাম্পগুলি তাতে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে বলে ওসি-রা জেলা পুলিশ-কর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনও প্রশ্ন না তুলে নিচু তলার অফিসারদের মহাকরণের নির্দেশ মানতে বলা হয়েছে।
কিন্তু তাঁর মৌখিক নির্দেশে জেলা পুলিশের মধ্যে যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে তা নিয়ে ডিজি কী বলছেন? তিনি বলেছেন, “সব পুলিশ ফাঁড়ি ও ক্যাম্প থেকে অস্ত্র তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা ছাড়া যেখানে দরকার নেই, সেই সব থানা থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে নিকটবর্তী পুলিশ কন্ট্রোলে জমা দিতে বলা হয়েছে। কে কী ভাবে তার ব্যাখ্যা করছেন, তা দেখতে হবে। কোথাও সমস্যা হচ্ছে জানলে যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে। তবে গুলি চালানোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে যা করণীয় তা করতেই এসপি-দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
মহরমের পথে পুলিশি টহল শিলিগুড়িতে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
মহাকরণ সূত্রের খবর, প্রত্যন্ত এলাকায় নানা সময়ে গড়ে ওঠা ফাঁড়ি ও ক্যাম্পের পুলিশকর্মীদের একাংশ আগ্নেয়াস্ত্রের অপব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য কারণে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটছে। রাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই রাইফেল দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে তল্লাশির নামে টাকা তোলার একাধিক অভিযোগও পৌঁছেছে পুলিশকর্তাদের কাছে। থানার অফিসাররা অভিযোগগুলি সম্পর্কে অবহিত হলেও তাঁদের প্রশ্ন, ফাঁড়ি থেকে সব অস্ত্র তুলে নিলে সেখানকার নিরাপত্তার কী হবে? সামান্য কারণে এখন মানুষ পুলিশের উপরে চড়াও হন। ফাঁড়িগুলি অস্ত্রহীন হয়ে পড়লে সেখানে পুলিশকর্মীদের ডিউটিতে পাঠানোই সমস্যা হবে বলে আশঙ্কা বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারদের।
জেলার পুলিশকর্তাদের কাছে সোমবার রাতে ডিজি-র ওই মৌখিক নির্দেশ পৌঁছনোর পরেই তা জানিয়ে দেওয়া হয় থানাগুলিতে। তার পরেই মঙ্গলবার সকাল থেকে পুলিশ ফাঁড়ি ও অস্থায়ী শিবির থেকে অস্ত্র তুলে থানায় জমা করার কাজ শুরু হয়ে যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি গ্রামীণ থানার ওসি বলেন, “মঙ্গলবার দুপুর ১২টা নাগাদ জানানো হয়েছে সমস্ত ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র তুলে থানার হেফাজতে রাখতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে অফিসার পাঠিয়ে সব অস্ত্র থানায় নিয়ে এসেছি।” কোন ফাঁড়ি থেকে কী অস্ত্র তোলা হল, কাদের কাছে ছিল সেই সব অস্ত্র, তা বিস্তারিত লিখে থানায় ডায়েরি করে রেখেছেন ওসি-রা।
দুই ২৪ পরগনায় এমন অনেক প্রত্যন্ত এলাকা রয়েছে যেখানে ডাকাতির আশঙ্কা সব সময়েই থাকে। ডাকাতি দমনেই সেই সব এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল। এখন বন্দুকে লাগামের নির্দেশ তাদের কাছে যে আকারে এসে পৌঁছেছে, তার ভিত্তিতে ওসি-রা প্রশ্ন তুলেছেন, ফাঁড়ি বা ক্যাম্প থেকে আগ্নেয়াস্ত্রই যদি তুলে নেওয়া হয়, তা হলে সেগুলি রেখে কী লাভ। সেখানে পুলিশ রাখারও যুক্তি আছে কি না উঠেছে সেই প্রশ্নও। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহের সীমান্তবর্তী এলাকার পুলিশ কর্মীরাও সেই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, অস্ত্র থাকে বলেই ফাঁড়িগুলি মানুষের কাছে ভরসাস্থল। দক্ষিণবঙ্গের এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “ওসি-রা জানতে চাইছেন, থানায় অস্ত্র থাকবে, অথচ পুলিশের হাতে অস্ত্র থাকবে না, তা হলে থানা কী ভাবে নিরাপদ রাখা যাবে?” জবাবে ওই পুলিশ-কর্তা তাঁর এসপি-র সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন ওসি-দের। এসপি-র কাছে ডিএসপি, এসডিপিও-রা এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তাঁদের মহাকরণের ডিজি কন্ট্রোলে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
থানা থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে নেওয়ার নির্দেশের পাশাপাশি ডিজি জানিয়ে দিয়েছেন, অনুমতি ছাড়া থানার কনস্টেবলরা এখন থেকে আর রাইফেল ব্যবহার করতে পারবেন না। কোথাও উত্তেজিত জনতাকে সামাল দিতে যদি তাদের হাতে অস্ত্র দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, ওসি-দের সেই অনুমতি নিতে হবে সংশ্লিষ্ট মহকুমা পুলিশ অফিসার কিংবা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছ থেকে।
ডিজি যা বলেছেন নির্দেশের যা ব্যাখ্যা হয়েছে
থানা থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে কন্ট্রোলে জমা পুলিশ ফাঁড়ি বা ক্যাম্পে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নয়
কেবল অনুমতি সাপেক্ষে কনস্টেবলদের রাইফেল ব্যবহার ফাঁড়ি, ক্যাম্পের সব অস্ত্র থানায় জমা
যথেচ্ছ গুলি চালানোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ব্যবস্থা কনস্টেবলরা শুধু গাদা বন্দুক ব্যবহার করবেন
কড়া ভাবে মানতে হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর ঘটনাস্থলে আর সশস্ত্র রক্ষী পাঠাতে পারবে না থানা
এই নির্দেশ নিয়ে নানা প্রশ্নে পুলিশের নিচুতলার একাংশের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। পুলিশকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, ইদানীং প্রায় সব জেলায় দুষ্কৃতীদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকার খবর রয়েছে। তা হলে মান্ধাতা আমলের গাদা বন্দুক দিয়ে তার সুষ্ঠু মোকাবিলা করা কতটা সম্ভব সেই প্রশ্নেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি, পুলিশের মধ্যেই যে সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা হল, জনতা মারমুখী হয়ে যদি পুলিশের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়, সে ক্ষেত্রে ডিএসপি বা উর্ধ্বতন অফিসার কত ক্ষণে পৌঁছবেন তার জন্য কি অপেক্ষা করতে হবে? বিষয়টি আদৌ কি যুক্তিযুক্ত? অনুমতি যত ক্ষণে পৌঁছবে, তত ক্ষণে বড় কিছু ঘটে গেলে, তার দায় কে নেবে? ফাঁড়ি বা ক্যাম্পে যদি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র না থাকে এবং জঙ্গি বা সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা আচমকা সেখানে হামলা করে, তা-ই বা সামাল দেওয়া যাবে কী ভাবে?
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, পুলিশকর্মীরা বিপদে পড়তে পারেন, এমন কোনও নির্দেশ দেওয়ার প্রশ্নই নেই। তা হলে এমন মৌখিক নির্দেশ কেন? ডিজি-র বক্তব্য, “ক্ষিপ্ত জনতাকে সামাল দিতে রাজ্যের পুলিশ আইনে যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) রয়েছে, সেটাই সব থানাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ডিজি বলেন, “এক সময়ে বিভিন্ন ধরনের হামলার আশঙ্কায় সব থানায় কার্বাইনের মতো অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। যেখানে এখন আর তেমন অস্ত্র দরকার নেই, সেখান থেকে তা তুলে কন্ট্রোল রুমে রাখতে বলা হয়েছে। কোথাও হামলার আশঙ্কা থাকলে অবশ্যই তা আলাদা ভাবে বিবেচনা করা হবে।” তবে অস্ত্র ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশ লিখিত ভাবে থানায় না-যাওয়ায় বিভিন্ন জেলায় পুলিশকর্মীদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি বাড়ছে, সে খবর মহাকরণে পৌঁছেছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি সূত্র অবশ্য দাবি করেছে, বিভ্রান্তির কোনও অবকাশ নেই। কারণ, প্রয়োজনে অস্ত্র কোথায় থাকবে আর কোথা থেকে তুলে নেওয়া হবে, সেই নির্দেশ লিখিত ভাবে সব জেলার পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দেওয়া হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.