|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
সাংস্কৃতিক ভর্তুকি কিন্তু বহু দেশেই আছে |
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ পালনে রাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ খরচ করছেন, সেখান থেকে সরকার কি কোনও রকম আর্থিক
লাভ প্রত্যাশা
করছেন? এটা একটা জাতীয় গর্বের প্রকাশ। সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণার সপক্ষে সওয়াল করেছেন
সুমন মুখোপাধ্যায়
|
দীর্ঘ ছ’মাস বন্ধ থাকার পর আবার ‘রাজা লিয়ার’-এর পুনরভিনয় শুরু হয়েছে, পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে। এই নাটক নিয়ে নানা আলোচনা, নানা তর্ক-বিতর্ক, নানা বিভ্রান্তি হয়েছে গত কয়েক মাস ধরে। বন্ধু নাট্যকার ব্রাত্য বসু, যিনি শিক্ষামন্ত্রী এবং মিনার্ভা নাট্যচর্চা কেন্দ্রের সভাপতিও বটে, তিনি একটা সাংবাদিক বৈঠক করেন এ বিষয়ে। ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নতুন সরকারের নতুন কমিটির সদস্যরা রাজা লিয়ারের পুনরভিনয়ের ব্যাপারে উৎসাহী এবং নাটকের পরিচালক হিসেবে তাঁরা আমার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। সেই আলোচনা হয়েছিল এবং রাজা লিয়ার যে আবার মঞ্চস্থ হবে এবং চলচ্চিত্রায়ণও হবে, এই দু’টি ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অনেকেই এই সিদ্ধান্তে স্বস্তি পেয়েছেন। কারণ, লিয়ার এখনও অনেকের দেখা হয়ে ওঠা হয়নি। তার মূল কারণ মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহের মাত্র তিনশো আসন প্রায় নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বাস্থ্যের কারণে খুব বেশি অভিনয় করা সম্ভব নয়। ২০১০-এর নভেম্বর থেকে ২০১১-এর মে মাস পর্যন্ত কুড়িটা অভিনয় হবার পর রাজনৈতিক পটবদল ঘটে এবং বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রকে সাংস্কৃতিক দফতরে যে-সব বদল হয়, তার কারণে নাটকটি স্থগিত রাখতে হয়।
এই নাটক প্রসঙ্গে নানা আলোচনায় কয়েকটা বিষয় উঠে এসেছে, যেগুলো সম্বন্ধে কিছু কথা বলা দরকার। প্রথমত, লিয়ারের অনুষঙ্গে ‘বিপুল ব্যয়ভার’-এর কথা বার বার উঠে এসেছে। সেই আয়-ব্যয়ের হিসেব এবং সরকারের ক্ষতির খতিয়ান কাগজে-কলমে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পরিসংখ্যান দেওয়া হলেও পরিপ্রেক্ষিতটা পরিষ্কার করা হয়নি। মিনার্ভা রেপার্টরি পশ্চিমবঙ্গে প্রথম সরকারি রেপার্টরি। রেপার্টরির কাজের প্রক্রিয়া সাধারণ নাট্যদলের থেকে স্বতন্ত্র। পরিচালকের হাতে থাকে একটি নির্দিষ্ট দল যাঁরা বেতনপ্রাপ্ত পূর্ণ সময়ের শিল্পী, হাতে থাকে একটি নির্দিষ্ট মঞ্চ যেখানে মহড়া হয় এবং সেই মঞ্চেই তিলে তিলে প্রযোজনা গড়ে ওঠে, পূর্ণাঙ্গ চেহারা পায় এবং পরবর্তী কালে সেখানেই নাট্যাভিনয় হয়। |
|
মহলা। ‘রাজা লিয়ার’ ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি: অশোক মজুমদার। |
উত্তর কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়গুলিতে প্রায় একই পদ্ধতিতে নাট্যপ্রস্তুতি হত। ‘রাজা লিয়ার’ নাটকটি প্রযোজনা করার কথা তৎকালীন পরিচালন সমিতির পরিকল্পনায় আসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে। সৌমিত্রদাই আমার পরিচালনায় কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তার পরে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় পরিচালক হিসেবে। সিদ্ধান্ত হয় মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহেই শুধু অভিনয় হবে। উদ্দেশ্য প্রেক্ষাগৃহকে জনপ্রিয় করা। কিন্তু এটা তো পরিষ্কার জানা ছিল যে, পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনয় হলেও খরচ উঠবে না। শুধু লিয়ার কেন, কোনও নাটকেরই উঠবে না। বিজ্ঞাপন খরচ, হল ভাড়া, প্রযোজনা খরচ নিয়ে আজকের দিনে এক সন্ধ্যার অভিনয়ে যে খরচ হয়, তা তিনশো আসনের প্রেক্ষাগৃহে তোলা সম্ভব নয়, যদি-না বহুমূল্যের টিকিট করা যায়। কিন্তু ষাট টাকা মূল্যের বেশি টিকিট করলেই তার জন্য বিনোদন কর দিতে হয়। তার ঝক্কি অনেক। এবং বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে বহুমূল্যের টিকিটের চল নেই। মুম্বইতে পেশাদারি থিয়েটারের টিকিট হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। যেমন, নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়ে বা লন্ডনের ওয়েস্ট এন্ডে টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণ মার্কিনিরা বা বিলেতের দর্শকেরা তাই ও-পথ বিশেষ মাড়াবার সাহস করেন না। থিয়েটার ব্যবসায়ীদের তাতে কী আসে যায়? তাঁদের কাছে মুনাফাটাই প্রধান এবং শেষ কথা। ব্রডওয়ে এবং ওয়েস্ট এন্ডে তাই দেখা যায় মূলত পর্যটকদের আর সমাজের উচ্চবর্গের ‘এলিট’দের ভিড়। সাধারণ মানুষরা তক্কে তক্কে থাকেন কখনও কোনও বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে কি না বা থিয়েটার খোঁজেন অফ ব্রডওয়ে বা অফ অফ ব্রডওয়ের ছোট ছোট মঞ্চগুলোতে।
|
সংস্কৃতির স্বার্থ |
আবার, ইউরোপীয় দেশগুলোতে রয়েছে সরকারের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় মঞ্চ। যেমন ইংল্যান্ডে ন্যাশনাল থিয়েটার এবং রয়াল শেক্সপিয়ার কোম্পানি। জার্মানির প্রায় সব মুখ্য শহরে রয়েছে ন্যাশনাল থিয়েটারের মঞ্চ। বার্লিন শহরে রয়েছে একাধিক। পৃথিবী বিখ্যাত বার্লিনার এনসম্বল তার মধ্যে একটি। ফ্রান্স, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি দেশগুলোতেও তাই। ভারতে রয়েছে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা-র অধীনে একটা রেপার্টরি। এই সব রেপার্টরি মূলত চলে রাষ্ট্রের বা সরকারের অর্থানুকূল্যে। কারণ, যে বিপুল ‘ব্যয়ভার’-এ রেপার্টরিগুলো চলে, তা কখনওই শুধুমাত্র টিকিট বিক্রির টাকা থেকে ওঠে না। সুতরাং, রাষ্ট্রকে সেই ভর্তুকির দায়িত্ব নিতেই হয় সংস্কৃতির স্বার্থে।
অনস্বীকার্য, প্রথম বিশ্বের দেশের অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের দেশের অর্থনীতির কোনও তুলনা চলতে পারে না। কারণ, আমাদের দেশে পেশাদার নাট্যশিল্পের ব্যাপারটা বিশেষ ভাবে গড়ে ওঠেনি। যেটা ছিল, তা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে মরে গিয়েছে। চলচ্চিত্রে, সংগীতে, চিত্রকলায় যেমন একটা পেশাদার অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব, নাটকের ক্ষেত্রে সে রকম একটা অবস্থা তৈরি হয়ে ওঠেনি। তাই উৎপল দত্ত বা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করতে হয়েছে বাধ্যতামূলক ভাবে। এখনও করতে হচ্ছে বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীকে। যাঁরা করেননি বা করতে চাননি, তাঁরা যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। আজকে কৌশিক সেন, দেবশঙ্কর হালদারকেও তা-ই করতে হয়। অথচ শম্ভু মিত্র থেকে শুরু করে আমাদের থিয়েটারের প্রধান মানুষেরা সব সময়ই চেয়েছেন একটা স্থায়ী মঞ্চ, বার বার বলেছেন একটি পেশাদারি পরিকল্প তৈরি করার কথা। আমাদের দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা আছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়ার জন্য, তা যদি সরকার কাল বন্ধ করে দেন, তা হলে বহু নাট্যদলেরই নাভিশ্বাস উঠবে। বহু যোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং শিল্পী পথে বসবেন। এই টাকা থেকে কোনও লাভ হবার সম্ভাবনা নেই। তা হলে ‘প্রফিটেবল’ নয় বলে সরকারের এই অনুদান কি বন্ধ করে দেওয়া কাম্য হবে? সরকার এই অনুদানের মাধ্যমে একটাই আশা করে যে, এই অর্থের যেন অপচয় না হয় এবং ভারতবর্ষের শিল্পচর্চার এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ধারাটা যেন প্রবহমান থাকে। সুতরাং, প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় যে বিশ্বেই হোক, সরকারি অনুদানে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় শিল্পসংস্কৃতির চর্চা কোনও নতুন ব্যাপার নয়। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেমন সাংস্কৃতিক ভর্তুকি রয়েছে, তেমনই উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও। শুধু বেশি আর কম, সামর্থ্য অনুযায়ী।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ পালনে রাষ্ট্র যে বিপুল অর্থ খরচ করছেন, সেখান থেকে সরকার কি কোনও রকম আর্থিক লাভ প্রত্যাশা করছেন? এটা একটা জাতীয় গর্বের প্রকাশ। পশ্চিমবঙ্গের নাট্যদলগুলোর জন্য সব সরকারি প্রেক্ষাগৃহ যে ভাড়ায় দেওয়া হয়, তার আয়-ব্যয়ের হিসেব করলে ব্যালেন্স শিটে লাভ দেখাবে না। হল থেকে উপার্জন করতে গেলে ব্যক্তিগত মালিকানায় যে হলগুলো চলে, সেই ভাড়া রাখতে হবে। সেই ভাড়া গুনতে হলে বেশির ভাগ নাট্যদলই উঠে যাবে। যদি লাভের কথা ভাবতেই হয়, তা হলে বিশেষ মূল্যের এই বণ্টন বন্ধ করে দিতে হয়। এখানে রাষ্ট্র সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোয় একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আসলে ‘রাজা লিয়ার’ প্রযোজনাটির সৃজন পরিকল্পনায় যা ছিল, তার কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা হয়েছে। মঞ্চভাবনা থেকে শুরু করে প্রযোজনার সব ক্ষেত্রে। রাজা লিয়ার করবার জন্য যে ওই একটি মাত্র উপায় ছিল তা নয়। কেউ নিরাভরণ মঞ্চে একটি হ্যালোজেন জ্বালিয়ে এই নাটক কল্পনা করতে পারতেন। যেমন, জার্মানির একটা অত্যন্ত ধনী রাষ্ট্রীয় নাট্যমঞ্চে দেখেছি মাত্র তিনটে আলো ব্যবহার করে ‘আঙ্কল ভানিয়া’ অভিনীত হতে। আবার বার্লিনার এনসম্বলে দেখেছি বিপুল আয়োজনে রবার্ট উইলসন পরিচালিত ‘থ্রি পেনি অপেরা’ বা নিউ ইয়র্কের হার্ভে থিয়েটারে সুইডিশ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রযোজিত ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘মিস জুলি’। পিটার ব্রুক প্যারিসের ‘বুফস ডি নর্ড’ নামে যে থিয়েটারে ‘মহাভারত’ সহ শেষ বড় কাগজগুলো করেছেন, বা প্যারিসের বাইরে নুশকিন তাঁর ‘থিয়েটার ডু সলেইল’-এ যে-সব প্রযোজনা করেছেন, তার পেছনে রয়েছে ফরাসি সরকারের বিপুল আর্থিক সহযোগ। সরকার যদি এ-সব মহৎ শিল্পকর্ম এবং মহামান্য নির্দেশক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পাশে না দাঁড়াতেন, তা হলে বিশ্বের মানুষ অনেক বড় মাপের শিল্প দেখতেই পেতেন না। সুতরাং, সব রকমের কাজই হতে পারে। আমার কল্পনায় ‘রাজা লিয়ার’কে ঘিরে নাট্যভাষের রূপ বিন্যস্ত হয়েছিল, আমি সেটাকেই মঞ্চে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় পেয়েছি সেই রূপকল্পের অনুমোদন। কিন্তু সমস্যাটা হল যখন দর্শকের বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও প্রযোজনাটাকে আরও আগে বেশি আসনের প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যাওয়া হল না। তা হলে হয়তো আগেই আয়-ব্যয়ের হিসেবে বিভেদের চিত্রটা এত প্রকট হত না।
|
‘বিপুল’ ব্যয়ভার |
এই প্রযোজনা তৈরি হওয়ার সময় আর একটা বিশেষ শর্ত ছিল নাটকটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ করা। সেই কারণে আমাকে কয়েকজন অভিজ্ঞ অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে হয়। লিয়ারের ভূমিকায় সৌমিত্রদাকে নিয়েই এই প্রকল্পের অবতারণা। এ ছাড়া গনেরিল, রেগন, গ্লস্টার, বিদুষক এবং কেন্টের চরিত্রগুলোর জন্য আমি রেপার্টরির বাইরের কিছু শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাই। রেপার্টরির চোদ্দো জন পূর্ণ সময়ের শিল্পীরা অত্যন্ত পরিশ্রমী, দায়বদ্ধ এবং তাঁদের দক্ষতা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এঁরা সবাই তরুণ-তরুণী। এমন নয় যে এই তরুণ তুর্কি দলটার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। পূর্ণ সময়ের শিল্পী হিসেবে নিয়োগের জন্য যে নির্বাচনী কর্মশালা হয়েছিল, তার এক জন প্রশিক্ষক ছিলাম আমি। কিন্তু কিছু কিছু চরিত্রের ক্ষেত্রে আমাকে বয়সের এবং চরিত্রায়ণের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয়েছিল। রূপসজ্জার নানা জাদু থাকতে পারে, কিন্তু সেটা যে সব সময় কার্যকর হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, বিশেষত সময় যেখানে সীমিত। বাংলা নাট্যজগতে আগে দলতন্ত্রের নানা রকম বাধানিষেধ ছিল। এখন সব নাট্যদলের মধ্যেই আমন্ত্রিত শিল্পীর চল হয়েছে। সেটা খুব প্রয়োজনীয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নানা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার যেমন অবকাশ পান, তেমনই পরিচালকরাও দক্ষ শিল্পী পান। এই নাটকের বাকি অনেকগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অসম্ভব ভাল অভিনয় করেছে রেপার্টরির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কিন্তু কোনও কারণে একটা প্রচার হল যে, ‘রাজা লিয়ার’ নাটকে নাকি রেপার্টরির স্থায়ী শিল্পীদের মধ্যে মাত্র চার জন আছেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল।
আমার মনে হয়, রেপার্টরি কাজটা ঠিক কী, সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। সাধারণত নিজস্ব থিয়েটার দলগুলোতে আমরা যে ভাবে নাট্যচর্চা করি, তার সঙ্গে রেপার্টরি ব্যবস্থার একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। নাট্যদলগুলো যে-সন্ধ্যায় অভিনয় করবে, তার তিন বা দুই ঘণ্টা আগে মঞ্চ পায়। ছুটির দিনে তারও কম। কারণ, সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায় নাটক হয়। সেই সামান্য সময়ের অবকাশে যতটুকু করা সম্ভব, সেটা মাথায় রেখেই মঞ্চসজ্জা এবং আলোকসজ্জা করতে হয়। কিন্তু রেপার্টরি ব্যবস্থায় অবকাশ রয়েছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অনেকটা সময় ধরে। ‘রাজা লিয়ার’ প্রায় আড়াই মাস এক মঞ্চে মহড়া হয়েছে। পরবর্তী প্রযোজনা ‘দেবী সর্পমস্তা’ হয়েছে প্রায় চার মাস। ফলত সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হবে, সেটা স্বাভাবিক।
আবার, ‘বিপুল ব্যয়ভারের’ প্রসঙ্গে যে হিসেব প্রকাশ করা হয়েছে, তার মূলে রয়েছে আলো আর শব্দের খরচ। এটাই লক্ষণীয় যে, এই দুটো ক্ষেত্রেই বাংলা থিয়েটারে সবচেয়ে বেশি অবহেলা। যে যত্নে এক জন সংগীত পরিচালক আধুনিক রেকর্ডিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগীত রেকর্ড করেন, সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়, যখন একটা সাধারণ যন্ত্রে সেই সংগীত প্রক্ষেপণ হয়। যাতে এমনটা না ঘটে সেটা শুধু ‘রাজা লিয়ার’ কেন, সব নাট্য প্রযোজনাতে আমি সেই ব্যাপারে সচেতন থাকার চেষ্টা করি। আর আলোকশিল্প যে উচ্চাঙ্গে পৌঁছেছে, তার কিয়দংশ আমরা ব্যবহার করতে পারি না। দেখেছি আলোকশিল্পীদের ভীষণ আক্ষেপ। আমরা বাজেটের দোহাই দিই, কিন্তু আমার মনে হয় এটা মনোভাবের প্রশ্ন। একটা দায়সারা ভাব যেন চেপে বসেছে, ‘এ ভাবেই যখন চলে যাচ্ছে’, তখন আর দরকার কী? তাপস সেন বহু বছর ধরে দোরে দোরে ঘুরেছেন আলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য, একটা অ্যাকাডেমি গড়ে তুলতে। কিন্তু তা তিনি গড়ে যেতে পারেননি আমাদের উদাসীনতার কারণে। নাট্যশিল্পীরাই যদি দাবি না তোলেন অবস্থা পরিবর্তনের জন্য, আর কে তুলবেন? |
|
|
|
|
|