বিতর্ক...
উন্নয়ন মাওবাদের উত্তর নয়
পক্ষে

সব গরিবই তো মাওবাদী নয়

শুধুমাত্র উন্নয়ন মাওবাদের উত্তর হতে পারে না। উত্তর হবে বহুমুখী। মাওবাদ বলতে শুধুমাত্র জঙ্গলমহলের যে হিংসার রাজনীতি এবং প্রতিশোধস্পৃহামূলক কার্যকলাপ, তাকে ধরলে হবে না। এই হিংসাপূর্ণ মাওবাদের সঙ্গে যুক্ত হল মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি, যাদের নেতৃত্বের উৎস নিপীড়িত মানুষের সমর্থনে, কিন্তু বাস্তবে যারা সেই সব মানুষের স্বার্থচিন্তা থেকে বহু দূরে। এ প্রসঙ্গে রাঁচি ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য ড. রামদয়াল মুন্ডার ভাষার সাহায্য নিয়ে বলতে হয়, মাওবাদের উত্তর শুধুমাত্র উন্নয়নের মাধ্যমে করা হলে সেটা হবে ফুটো পাত্রে জল ঢালার সমান। মাওবাদ উদ্ভবের আর্থ-সামাজিক কারণগুলি হল অত্যাচার, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, পারস্পরিক আস্থার অভাব, ভৌগোলিক ভাবে প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান (যদিও ওই সব অঞ্চলে মাটির নীচে খনিজ সম্পদ ও উপরে বনজ সম্পদ রয়েছে), শিক্ষার অভাব, অনুন্নয়ন ইত্যাদি। মাওবাদের উত্তর দিতে গেলে উপর থেকে উন্নয়ন চাপিয়ে দিলে হবে না; শুরু করতে হবে বিক্ষোভের উৎস থেকে। যেমন শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য দূর করা, পারস্পরিক আস্থা জাগানো, রোজগারের পথ দেখানো, সর্বোপরি তাদের আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার।
বন থেকে বাঘ তুলে আনা যায়, কিন্তু বাঘের মন থেকে বনকে তুলে ফেলা যায় না। তেমনই উন্নয়ন দিয়ে মাওবাদীদের মন থেকে জঙ্গিপনা কখনওই নির্মূল করা যায় না। উন্নয়নের কোনও সীমা হয় না। চাহিদার শেষ হয় না, বরং তা বেড়েই চলে। সুতরাং, উন্নয়নের দুধকলা নয়, বিচ্ছিন্নতা আর প্রতিরোধ নামক হেঁতালের লাঠিই হল কালসাপরূপী মাওবাদকে বশ করানোর একমাত্র ওষুধ।
আমাদের রাজ্যে বেশ কিছু এলাকা আছে, যেখানে রাজ্যের মাও-উপদ্রুত এলাকার তুলনায় উন্নয়ন বেশ পিছিয়ে আছে, কিন্তু ওই সব অঞ্চলে জঙ্গি মাওবাদীদের আবির্ভাব ঘটেছে বলে খবর নেই। সুতরাং, রাজ্যের বর্তমান মাওবাদী সমস্যার পিছনে অনুন্নয়ন মূল কারণ; আর এই সমস্যার সমাধানে উন্নয়ন একমাত্র পথ, এই যুক্তি বাস্তবসম্মত নয়।
স্বাস্থ্যকর্মীদের গাড়ি ল্যান্ডমাইনে ওড়ানো, গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস খুলতে না দেওয়া, মোটা গাছ কেটে পথে ফেলা; সন্ধেবেলা সেই গাছ পাচার করা, গরিব মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজে বাধা দান, এগুলো কখনওই উন্নয়নের দাবি হতে পারে না। যে টাকায় ল্যান্ডমাইন বা অস্ত্রশস্ত্র কেনা হয়, তার সিকিভাগ ব্যয় করে এই অসহায়দের পাশে থাকা যেত। তা হয়নি। উল্টে যারা পরোপকারী, তাঁদের অভাব-অনটন ও বিপদ-আপদে নানা ভাবে পাশে থাকেন, তাঁদের খুনের হুমকি দিয়ে বসিয়ে দিতে এরা যথেষ্ট উদ্যোগী। এরা কোনও দিন উন্নয়ন চাইবে না। মাওবাদের আড়ালে মাফিয়ারাজ বাঁচিয়ে রাখতে চায় এরা। উন্নয়ন দিয়ে মাওবাদীদের রোখা যাবে না।
জঙ্গলের মানুষ এখন উন্নয়নের নামে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষ ভাবছেন উন্নয়নের নামে প্রমোটাররাজ কায়েম হবে, তাদের ভিটেমাটি ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হতে হবে। উন্নয়নের নামে পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে মাওদের কাছে নিরাপত্তা খুঁজছেন মানুষ। চাল দিয়ে, ভোটের ছবি তোলার লোভ দেখিয়ে, যৌথবাহিনী, পুলিশি সন্ত্রাস, নেতাদের রক্তচক্ষু দিয়ে উন্নয়ন হয় না। জঙ্গলের মানুষ একটু শান্তির জন্য বিপ্লবী মাওবাদের বর্মের মধ্যে বাস করছে। সমস্তই বাঁচার তাগিদে। ওদের আস্থা, বিশ্বাস কোনও সরকার অর্জন করতে পারেনি। উন্নয়নের আশ্বাস দিয়ে তাই মাওদের প্রতি সমর্থন কমানো যাবে না।
বিপক্ষে

ভয় দেখিয়ে দলে টানা যাবে না

উন্নত এলাকায় মাওবাদের বিশেষ প্রভাব নেই। জঙ্গলের মানুষের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, জীবিকার সুবন্দোবস্ত হলে দীর্ঘ দিনের অবহেলা, বঞ্চনার যোগ্য জবাব হবে। মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে মাওবাদীরা তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের চাহিদার সব কিছু পূরণ হতে থাকলে জনগণকে লোভ দেখিয়ে, ভীতি প্রদর্শন করে কিংবা ভুল বুঝিয়ে দলে টানা সম্ভব হবে না।
যে প্রেক্ষাপটে মাওবাদের জন্ম, সে এক দীর্ঘকালীন অবজ্ঞা, অবহেলা, শোষণ ও গণতন্ত্র অপব্যবহারের পটভূমি। যার মূলে রয়েছে অনুন্নয়ন। যদিও মাওবাদের ভাবাদর্শের কাঠিন্যে রক্তের ছোপটাই লেগেছে বেশি, তবু অস্বীকার করার নয়, যাঁরা মাওবাদকে টেনে নিয়ে চলেছেন, তাঁদের বড় অংশটাই অনুন্নত ও শোষিত স্তর থেকে উঠে আসা। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে, যদিও উন্নত সমাজব্যবস্থার সার্বিক সুযোগ-সুবিধা এই শ্রেণির হাতে পৌঁছত, তবে এত বেশি, এত সংগঠিত মাওবাদীর জন্মই হত না। বর্তমান পরিস্থিতি তাই যা-ই হোক, অনুন্নয়নকে মেনে নিতে না পেরেই মাওবাদের জন্ম, এ কথা বলা অবান্তর নয়। অতএব, উন্নয়নই যে এর শেষ উত্তর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকাশ ব্যতীত পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও সক্রিয় আন্দোলন যেমন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি, তেমনই উন্নয়ন ব্যতীত মাওবাদকে প্রতিহত করাও দুঃসাধ্যের।
জঙ্গলমহলের সারেঙ্গা, গোয়ালতোড় প্রভৃতি অঞ্চলে জনমজুরের প্রাপ্য হল সাত পাই ধান, যা আদতে সাড়ে পাঁচ কিলো ধানের সমান। ধানের দাম অনুসারে জনমজুর পায় মাত্র চল্লিশ টাকা। দুপুরের খাওয়া ধরলে বড় জোর পঞ্চান্ন-ষাট টাকা প্রাপ্তি ঘটে। শহরে মজুর খাটলে, দালালের কমিশন বাদ দিয়েও একশো কুড়ি-তিরিশ টাকা অনায়াসেই পাওয়া যায়। এখানে মানুষ বেঁচে আছে স্রেফ মাটির নীচ থেকে পাওয়া মিষ্টি আলু, দাঁড়াস সাপ, গো-সাপ বা খরগোশের মাংস ঝলসে খেয়ে। ব্যাঙের ছাতা, শালুকের ডাঁটা খেয়েও দিন কাটায়; তবু বি পি এল তালিকাভুক্ত নয়। অথচ পঁয়ত্রিশ বিঘার জমির মালিক হাসতে হাসতে বি পি এল কার্ডের সুবিধা পেয়ে থাকে। যাঁরা পঞ্চায়েতের মাতব্বর, তাঁদের স্ত্রী-পুত্র আত্মীয়-স্বজনরা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা স্কুলের পিয়ন-বেয়ারার চাকরি পায়। তাই তো পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের তরজা ধোপে টেকেনি। দু’-চার মুঠো গরম ভাত খেতে পেলে যারা মহাভোজের তৃপ্তি লাভ করে, তাদের জন্য উন্নয়নই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সুতরাং, উন্নয়নই মাওবাদের যোগ্য উত্তর।


উন্নয়নকামী না-খেতে-পাওয়া মানুষদের নিয়েই মাওবাদীরা লড়াই করে চলেছে। স্বার্থান্বেষী এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতার অনৈতিক ক্রিয়াকর্মের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাওয়া উন্নয়নকে বাঁচাতে তাঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। প্রকৃত উন্নয়ন থাকলে জঙ্গলমহলের অসহায়, শোষিত, বঞ্চিত মানুষদের মাঝে মাওবাদের জন্ম হত না। উন্নয়ন হলে গরিব, সহজ-সরল গ্রাম্য মানুষ মাওবাদকে প্রশ্রয় দিত না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি থেকে বঞ্চিত মানুষ যখন জঙ্গলের কাঠ-পাতার ন্যায্য মূল্যের ওপর ভিত্তি করে স্বপ্নপূরণের নেশায় মাতে, তখন প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে এই মাওবাদ। জঙ্গলমহলের জীর্ণ রাস্তা ধরে হেঁটে চলা অভুক্ত বেকারত্ব যখন উন্নয়নের আলো খোঁজার স্বপ্ন দেখে, তখন বাতির পুড়ে-যাওয়া সলতের মতো জীবনটাও দপদপ করে শেষ হতে হতে আশ্রয় পায় মাওবাদের সংগ্রামী আখড়াতে। হাতে অস্ত্র নিয়ে গর্জে উঠে তাদের বিরুদ্ধে, যারা উন্নয়নের নামে ভোট খোঁজে, কিন্তু ভোটের পর উন্নয়নের টাকা পকেটে গুঁজে ‘দেখছি দেখব’ গোছের সান্ত্বনাবাণী বলে মানুষের প্রতিবাদ ও প্রত্যাশাকে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে অবদমিত করার চেষ্টা করে। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ দ্বারাই মাওবাদ-বিরোধী জোয়ার আসবে। উন্নয়নই মাওবাদের একমাত্র উত্তর।
উন্নয়ন মাওবাদের উত্তর নয়, এ কথাটা আমি মনে করি না। সাধারণ মানুষ দু’বেলা ভালমত খেতে পারলে, বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে তারা সরকার-বিরোধী কাজ চালিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। সবটাই নির্ভর করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
জঙ্গলমহলের অধিবাসীরা বাম শাসনের লাগাতার বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার। এবং এই বঞ্চনাই তাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে। তারা অস্ত্র ধরেছে এবং সমাজের মূলস্রোত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। বাম আমলে ওই সব অঞ্চলে উন্নতি যে শুধু থমকে গেছে তা-ই নয়, মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে অখাদ্য-কুখাদ্য খেতে বাধ্য হয়েছে। বাম সরকার যে চূড়ান্ত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে, তার অবসান টানতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। উন্নয়নকে হাতিয়ার করে জঙ্গলমহলের চেহারাটাই পাল্টে দিতে চান। অঞ্চলের অধিবাসীরা মমতার সদিচ্ছার কথা বুঝতে পেরে অধিক সংখ্যক লোক মমতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, জঙ্গলমহলের সার্বিক উন্নতি হলে তারা মাওবাদীর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। মাওবাদীরাও সরকারি মনোভাব বুঝতে পেরে আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে যুদ্ধবিরতির জন্য মমতার কাছে পীড়াপীড়ি করছে। কারণ তারা জানে, আর্থ-সামাজিক উন্নতি মানসিক উন্নতিকে তরান্বিত করে। সে ক্ষেত্রে তাদের বৈরী মনোভাব বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার দৃঢ় ধারণা, মাওবাদী সমস্যার সমাধান উন্নয়নের হাত ধরেই আসবে।
উন্নয়ন মাওবাদের উত্তর নয় এ কথা কোনও মতেই মানা যায় না। আজ বাংলা-বিহার-ওড়িশার যে অঞ্চলকে মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল বলে অভিহিত করা হচ্ছে, এক বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা যাক না যে এই অঞ্চলে মাওবাদী গোষ্ঠীর সৃষ্টির পশ্চাৎপটটা কী? চরম বঞ্চনা আর অবহেলা। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্যতা যেখানে কিছুই নেই; যেখানে আজও পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে এক জন মানুষেরও পায়ে চটি বা জুতো দেখা যায় না; যেখানে প্রত্যন্তরে আজও বাড়িতে ভাত রান্না হওয়া মানে সে দিন উৎসব! নেই স্বাভাবিক জীবনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা।
জানুয়ারির মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এই ঠিকানায়
ডিসেম্বর মাসের বিতর্ক, সম্পাদকীয় বিভাগ,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.