সূর্যালোকের নীচে যে কোনও বিষয়েই যে দল ‘নৈতিক অবস্থান’ নিয়ে থাকে, নজিরবিহীন নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে তাদেরই কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য পদাধিকারীদের কেন বিধি পাশ করে পদ রক্ষা করতে হবে বিতর্ক ঘনীভূত সিপিএমের অন্দরে!
বিতর্কের সূত্রপাত দলের যে কোনও কমিটির সম্পাদক পদে কেউ তিন দফার বেশি থাকতে পারবেন না, এই মর্মে কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর। সেই বিতর্ক আরও গতি পেয়েছে বিভিন্ন রাজ্য সম্মেলনের দিনক্ষণ পলিটব্যুরোয় অনুমোদিত হতেই। সিপিএম সূত্রের খবর, চার বারের কেরলের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন এ যাত্রায়ও তাঁর গদি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির ওই প্রস্তাবকেই ‘ঢাল’ করতে চাইছেন। দলের পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের মতে, সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট যথারীতি বিজয়নের পক্ষে আছেন। এবং বিজয়ন যদি শেষ পর্যন্ত পদে থেকে যান, আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে তাঁর তরফ থেকেও ‘পূর্ণ সমর্থন’ থাকবে কারাটের প্রতি। এই ‘পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা’র প্রয়াস দেখেই সম্পাদকদের মেয়াদ বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন দলীয় নেতৃত্বের একাংশ।
কেন্দ্রীয় কমিটির ওই প্রস্তাব কার্যকর হবে পার্টি কংগ্রেসে অনুমোদিত হলে। তা কার্যকর করার জন্য দলের গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনতে হবে। সংশোধনীর খসড়া তৈরি করবে পলিটব্যুরো। পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব পাশ হয়ে সংশোধনী গৃহীত হলে দু’দিক থেকে দু’ভাবে লাভবান হবেন কারাট-বিজয়নেরা। সাধারণ সম্পাদক পদে কারাটের মেয়াদ এখনও তিন দফা হয়নি। তাই তিনি ‘ছাড়’ পেতে পারেন। আবার নিয়মটি পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে চালু হওয়ায় (তার আগেই রাজ্য সম্মেলন হয়ে যাবে) বিজয়ন তার ‘আওতা-মুক্ত’ হওয়ার সুযোগ পাবেন! দলের একাংশের বক্তব্য, আইনের ‘ফাঁক’ খুঁজে বার করার চেষ্টা না-করে কারাট-বিজয়নেরা বরং সম্মেলনে নিজেরাই পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। তবে কারাটের তরফে সেই দাবি মানার কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত নেই।
নীতিগত ভাবে কারাট-বিজয়নদের সরে দাঁড়ানো উচিত বলে যাঁদের অভিমত, তাঁদের যুক্তি গত লোকসভা ভোট থেকে সিপিএম ‘অভূতপূর্ব’ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই ‘নজিরবিহীন’ পরিস্থিতিতে কিছু ‘বেনজির’ সিদ্ধান্ত সংগঠনে নিতে হবে। বিপর্যয়ের ‘নৈতিক দায়’ নিয়ে
যেমন কারাটের সরে গিয়ে দৃষ্টান্ত দেখানো উচিত,
তেমনই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত বিজয়নেরও স্বেচ্ছায় পদ ছাড়া উচিত। পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “আমরা এমন একটি দল, যারা যে কোনও বিষয়ে নৈতিক অবস্থান নিয়ে থাকি। সেই দলেই একটা প্রস্তাব কবে থেকে কার্যকর হবে, কে কী ভাবে তার বাইরে থাকতে পারবেন সে সব আইনি খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে কেন? নীতিগত অবস্থানে দাঁড়িয়েই দৃষ্টান্ত স্থাপনের কথা কেন ভাবা যাবে না?”
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রথম সারির সদস্যের বক্তব্য, “অনেক বেশি জনপ্রিয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে ভি এস অচ্যুতানন্দনকে পলিটব্যুরো থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। অথচ লাভালিন-সহ আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজয়ন রাজ্য সম্পাদক থেকে গিয়েছেন। এর পরেও নিয়মের ব্যতিক্রম হিসাবে তিনি পদে থেকে গেলে সর্বত্র দলের কর্মীদের কাছে কী বার্তা যাবে?” প্রসঙ্গত, কেরলে রাজ্য সম্মেলন ৭ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি তিরুঅনন্তপুরমে। যা এপ্রিলে কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেসের আগে। ফলে, পার্টি কংগ্রেসে কোনও বিধি চালু হলেও বিজয়ন (বা যে কোনও রাজ্য সম্পাদকই) তার আগেই ‘কাজ’ গুছিয়ে নিতে পারবেন! চার বারের রাজ্য সম্পাদক বিজয়ন এ বার পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যানও হয়েছেন। তাঁর ‘গুরুত্ব’ কমার কোনও লক্ষণই এখনও পর্যন্ত নেই।
তিন দফার বিধিনিষেধ প্রযোজ্য না-হলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুরও ‘নৈতিক অবস্থান’ নিয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করে দলের একাংশ। ‘ভাল মানুষ’ এবং সকলকে নিয়ে চলার মানসিকতা থাকলেও রাজ্যে দলের সর্বময় কর্তা হিসাবে যথেষ্ট ‘দক্ষতা’ তিনি দেখাতে পারছেন কি না, বিমানবাবুর বিভিন্ন প্রকাশ্য মন্তব্য থেকেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে তা কখনওই কারাট-বিজয়নদের মতো ‘জোরালো’ নয়। দলের একাংশ মনে করে, সাধারণ সম্পাদক বা রাজ্য সম্পাদকের মতো শীর্ষ নেতৃত্বে বদল না-হলে শুধু লোকাল, জোনাল বা ক্ষেত্রবিশেষে জেলা সম্পাদক পরিবর্তন করে জনমানসে দলের ভাবমূর্তি পাল্টানো যাবে না। উপর দিকে বদল না-হলে নিচু তলায় ‘নৈতিক বাধ্যবাধকতা’ও দুর্বল হয়ে যায়। তবে অন্য একাংশের পাল্টা যুক্তি, “সাধারণ মানুষকে নিয়ে চলতে হয় স্থানীয় নেতাদেরই। লোকাল সম্পাদক ঠিক না-থাকলে রাজ্য সম্পাদক পদে যিনিই আসুন, খুব একটা তফাত হবে না!”
যুক্তি-পাল্টা যুক্তির এই আবহে বিতর্ক বাড়ছেই সিপিএমে! |