শীতকালীন অধিবেশন শুরুর পরে দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত এক দিনও সংসদের স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়নি। চার দিন বিরতির পরে আগামিকাল ফের সংসদ বসছে। অচলাবস্থা কাটাতে সেখানে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত ‘স্থগিত’ রাখার কথা ঘোষণা করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তার পরেও সংসদ চলবে কি না, সেই সংশয় জিইয়ে আজ বিজেপি ও বাম, দু’পক্ষই দাবি তুলেছে, স্থগিত নয়, বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বাতিল করতে হবে কেন্দ্রকে। এই দাবিতেই আগামিকাল সংসদে সর্বদল বৈঠকে একযোগে সরব হবে বাম-বিজেপি। দু’পক্ষের সংসদীয় নেতৃত্বের মধ্যে এই নিয়ে মঙ্গলবারও কথা হয়েছে। লোকসভার বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ বাম নেতৃত্বকে ফোন করেছিলেন। সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া, সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্তেরা তাঁদের আগের অবস্থানেই অনড় থেকে বলেছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে। তবে সংসদের কাজকর্ম শুরু হোক, তা তাঁরাও চাইছেন।
মনমোহন-সরকার অবশ্য আশাবাদী যে, সংসদের অচলাবস্থা কাটতে চলছে। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী মূল্যবৃদ্ধি ও কালো টাকা নিয়ে বিতর্ক হবে ধরে নিয়ে অর্থ মন্ত্রকে সরকারের জবাবি বক্তৃতা তৈরিরও প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কালই কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা ও সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে কথা বলেন। সরকার মনে করছে, তখনই প্রণব বিরোধী নেতাদের বোঝাতে পেরেছেন যে, ঘরে-বাইরের চাপে সরকার অনেকটাই ঝুঁকেছে। এ বার সংসদ চলতে দেওয়াটা বিরোধীদেরও নৈতিক দায়িত্ব।
বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে, প্রণব যে ভাবে বুঝিয়েছেন, তার মর্মার্থ, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার ‘কার্যত’ পিছু হঠছে। বিজেপি ঠিক এইটাই চাইছিল। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন রয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে সর্বদলীয় বৈঠকে, সর্বোপরি সংসদে লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় কী ভাষায় প্রতিশ্রুতি দেন, তা সর্বজনগ্রাহ্য হয় কি না, তার উপরেই সংসদের অচলাবস্থা কাটা নির্ভর করছে বলে জানিয়েছে তারা। বিজেপি চায়, সংসদ চলুক। কিন্তু সিপিএম যদি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় থাকে, তখন বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে বিজেপিরও বিরোধিতা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। কংগ্রেস সূত্রের খবর, রাত পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ কর্তারা বিবৃতির যে প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, সব পক্ষের সঙ্গে ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হচ্ছে। এই খসড়ায় ‘স্টেক হোল্ডার’ শব্দটি নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দড়ি টানাটানি চলে। এমনকী, অভিধানও ঘাঁটাঘাটি করতে হয় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী-সহ সরকারের শীর্ষ কর্তাদের।
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের বক্তব্য, “স্থগিত নয়, আমরা পুরোপুরি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি। সরকার যদি মনে করে, এখন স্থগিত রাখার কথা বলে মিথ্যে ফাঁকি দিয়ে পরে আবার কাজ হাসিল করবে, তা হলে তারা ভুল করছে।” সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, প্রণববাবু আশ্বাস দিয়েছেন যে ‘বিরোধী পক্ষ’ ও ‘সংশ্লিষ্ট সকলের’ সঙ্গে কথা বলে ‘ঐকমত্যের’ পরেই ভবিষ্যতে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। সরকারি সূত্রে আবার বলা হচ্ছে, প্রণব শুধু আশ্বাস দিয়েছেন যে, ‘সংশ্লিষ্ট মহলের’ সঙ্গে কথা বলা হবে। সে ক্ষেত্রে বামেদের দাবি, ‘সংশ্লিষ্ট মহলের’ পাশাপাশি ‘বিরোধী দলের’ সঙ্গে কথা বলারও প্রতিশ্রুতি দিতে হবে সরকারকে। সুষমার সঙ্গে কথার পরে এ দিন কলকাতায় সিপিআইয়ের লোকসভার দলনেতা গুরুদাসবাবু বলেন, “কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, খুচরো ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারী পক্ষের (স্টেক হোল্ডার) সঙ্গে কথা বলে সহমত না-হওয়া পর্যন্ত বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত থাকবে। আমরা বলেছি, এই আলোচনাকারী পক্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলিকেও যোগ করতে হবে। সুষমা এক মত হয়েছেন।” সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “আমরা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারেরই দাবি তুলব। সরকার কী বলে, তার উপরে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে।”
বাম-নেতৃত্ব মনে করছেন, সরকার এখন প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরে যদি এক তরফা ভাবে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে প্রচার চালানো যাবে। বিজেপির মতো বামেরাও চান, সংসদ চলুক। কারণ মূল্যবৃদ্ধি, কালো টাকা, দুর্নীতির মতো বিষয়ে সংসদে সরকারকে আক্রমণ করতে চান বামেরা। বিজেপিও মনে করছে, এর পরেও সংসদ অচল থাকলে তার দায় বিরোধীদের উপরেই এসে পড়বে। লোকপাল বিল পাশ করানোর পথে বিজেপি-ই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে প্রচার করবে কংগ্রেস। বিজেপি কোনও ভাবেই অণ্ণা হজারে ও তাঁর সমর্থকদের রোষের মুখে পড়তে চায় না।
এই পরিস্থিতিতে আজ যে ভাবে প্রকাশ কারাট ‘রণং দেহি’ মূর্তিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবি তোলেন, তাতে প্রাথমিক ভাবে কিছুটা চিন্তাতেই পড়ে গিয়েছিল বিজেপি নেতৃত্ব। সিপিএমের সংসদীয় দলনেতা ইয়েচুরি বিজয়ওয়াড়ায়। বামেরা কড়া অবস্থানেই অনড় থাকছেন কি না, তা জানার জন্য হন্যে হয়ে ইয়েচুরির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন বিজেপির নেতারা। সিপিএমের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, দল নীতিগত ভাবে বিদেশি লগ্নির বিরুদ্ধে। সাধারণ সম্পাদক সে কথাই জানিয়েছেন। বিদেশি লগ্নির পক্ষে সরকার যে সব যুক্তি দিচ্ছে, তার পাল্টা যুক্তি সাজিয়ে প্রচার পুস্তিকা তৈরি করেও প্রচারে নামছে সিপিএম। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি আজ দিল্লির বিজেপি নেতাদের এই বিরোধিতা মহল্লায়-মহল্লায় গিয়ে প্রচারের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “এই বিষয়ে ইউপিএ দ্বিধাবিভক্ত। এমনকী এনডিএ আমলে যখন এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, কমল নাথের মতো কংগ্রেসের নেতারাই এই প্রস্তাবকে ‘দেশ-বিরোধী’ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন!”
সংসদের বাইরে প্রচার চালালেও বাম বা বিজেপি অবশ্য এখনও সংসদ অচল করে রাখার পক্ষে নয়। প্রকাশ কারাট বলেন, “আগামিকাল সরকার কী প্রস্তাব দিচ্ছে, তা শুনেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।” বিজেপি নেতৃত্বও মনে করছে, সরকারের আগামিকালের অভিব্যক্তির উপরে সব নির্ভর করছে। তবে সমাজবাদী পার্টি ও বসপা-র মতো দলগুলি কী অবস্থান নেবে, তা বিজেপির কাছে স্পষ্ট নয়। কংগ্রেসের তরফে অবশ্য আবেদন জানানো হয়েছে, সরকার যখন সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে, তখন এ বার সংসদ চলতে দেওয়া উচিত। কারণ প্রচুর বিল আটকে রয়েছে। সেগুলি পাশ না হলে আমজনতার স্বার্থই ক্ষুণ্ণ হবে। সরকারি সূত্রের খবর, আগামিকালই পাটচাষিদের জন্য ভর্তুকি ঘোষণা করা হতে পারে। রাজ্য সরকার গত বেশ কিছু দিন ধরেই পাটচাষিদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছে। |